জান্নাত এজা::
জুলাই ২০২৪। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু। আর দেশের বুকে চলা একটি শক্তিশালী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাক্ষী। কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে যে আগুন ছড়াল, সেটাই যেন ছড়িয়ে পড়ল দেশের প্রতিটি সচেতন হৃদয়ে। আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী, অরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষ করলাম সম্ভবত ১৬ বা ১৭ জুলাইয়ের পর।
প্রথমদিন বিজিএস ক্লাসে ম্যাম আমাদের তাচ্ছিল্যের সুরে বলছিলেন, “এই সময়টা খুবই ডিপ্রেসিভ।” পাশের সহপাঠী বলে উঠলো, “আমি তো সোশাল মিডিয়ার নোটিফিকেশনই অফ করে রেখেছি।” ম্যাম ও সহমত জানালেন বললেন উনিও করে দিয়েছেন সেইম। আমি থেমে থাকতে পারিনি- রাগে, ক্ষোভে ফেটে বললাম, “১৯৭১-এ যদি মুক্তিযোদ্ধারা ভাবতেন সময়টা ডিপ্রেসিভ, তবে আজ আপনি এখানে ক্লাস নিতে পারতেন না, আমরাও বসে থাকতে পারতাম না।” ম্যাম বলেছিলেন, “তুমি আবেগ থেকে বলছো।” আমি বুঝি, ওটাই তো আসল—এই আবেগই তো আমাদের রক্তে, ইতিহাসে।
এই দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হলো, “যারা আন্দোলনে যাবে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” সেদিন বাস শাবিপ্রবির সামনে থামতেই ভাইয়ারা নেমে গেলেন আন্দোলনের উদ্দেশ্যে। আমি চেয়েও নামতে পারলাম না- কারণ না আমার আইডি কার্ড ছিল, না সেই সাহস। মা জানলে আমার হাত পা ভেঙে দিবেন জানি।
এরপর এক এক মানুষ মারা যাওয়া , আবু সাঈদ ভাইয়ার মৃত্যু, ছোট বাচ্চাদের মৃত্যু, আর মুগ্ধ ভাইয়ার কণ্ঠে "পানি লাগবে ভাই, পানি"- সব শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হচ্ছিল পাষাণ। কিচ্ছু করতে পারছি না, কিছু বলতেও পারছি না।
অনলাইনে ফাহাদ স্যার, শুভ ভাইয়া, ইয়াসিন ভাইয়ার ছবি ভাইরাল- এমনভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে, যেন বড় কোনো অপরাধ করেছেন! এইদিন নিজে নিজের সাথে প্রমিস করলাম যাইহোক আর থেমে থাকবো না, এইবার যদি আন্দোলনে না যাই আমার থেকে বড় বেইমান আর কেউ হবে না। ফাহাদ স্যারের কারণেই আমি জীবনে প্রথমবার বায়োলজি পড়তে বসেছিলাম। ‘বন্দী পাঠশালা’র ওয়ান শট দেখে কলেজে পাস করেছিলাম!
এইসব দেখে আর বসে থাকতে পারলাম না। জানলাম সিলেটে ব্লুবাড স্কুল আন্দোলন করবে। কলেজের এক সিনিয়র ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করলাম আমাদের কলেজের সামনে কি এরকম কিছু হবে, উনি বললেন '' আমাদের কলেজের সামনে কিছু করার থেকে শাবিপ্রবিতে সবাই গেলে বেশি ভালো হবে। উনি একটা গ্রুপে এড দিলেন, সেখান থেকে শাবিপ্রবির একজন ভাইয়ার সাথে কথা হলো। ঠিক করলাম আন্দোলনে যাব। কিন্তু ভুল করে আগে গিয়ে ফেলায় অপেক্ষা না করে ফিরে এলাম।নপরদিন আবার গেলাম- এইবার কাউকে না জানিয়ে। এমনকি আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকেও না।
২ আগস্ট সন্ধ্যায় ফোন দিলো আপ্পি, বললো তুই কি আসতে পারবি? জুড়ীতে কালকে আন্দোলন করবো “জুড়িতে কাল আন্দোলন হবে।”
আমি এক লাফে রাজি! আম্মুকে বললাম বাড়ি যাব, কেন যাব তা বলিনি। কাজিন ভাইয়া আমাকে উনার পরিচিত সিএনজির সাথে কথা বলে দিলেন।
৩ আগস্ট ভোর ৫ টায় রওনা দিলাম। পুরো রাস্তা শুধু ভয় আর অস্থিরতায় ভরে ছিল। পুলিশের চেকপোস্ট আছে কিনা এই নিয়ে টেনশনে ছিলাম। সিএনজি মামা ছিলেন খুব ভালো—বললেন, “আমার মেয়েও আন্দোলনে আছে।” কথাটা কিছুটা শান্তি দিল।
রাস্তায় ওঠার আগে ফোনের সব মেসেজ, গ্রুপ, ছবি—সব ডিলিট করে দিলাম। এমনকি যে মেয়েদের গ্রুপ ছিল, সেখান থেকেও লিভ নিলাম।
২ আগস্ট রাতে স্কুলের এক বান্ধুবি মেসেজ করেছিলাম তুই কি আন্দোলনে আসবি? ও বলেছিল, “উপর (সংগঠন) থেকে না বললে পারবো না। অথচ ৫ আগস্টে ও-ই স্টেটাস দিয়েছে “আমাদের জন্যই দেশ স্বাধীন!” কী হাস্যকর!
সকাল ৭টার দিকে বাড়ি পৌঁছালাম। যোগাযোগ করলাম সকলে সঙ্গে, জানালাম “আমি এসেছি।” ১২/১ টার সময় আপ্পি এলেন আমাকে নিয়ে যেতে। জুড়ী আইডিয়াল স্কুলে গিয়ে দেখি ভাইয়া-আপুরা আসছেন- কারও হাতে প্ল্যাকার্ড, কারও চোখে আগুন, সবার বুকে বিশ্বাস।
সিদ্ধান্ত হলো, একসাথে না গিয়ে ২-৩ জন করে লন্ডন প্লাজায় জমা হবো।
মিছিল শুরু হলো, বনলতা পর্যন্ত যেতে পুলিশ বাধা দিল, আমরা থামিনি। মিছিল চললো নাইট চৌমুহনা অবধি। সেখানে পুলিশ কথা বলতে এলো—তখন আমি বললাম,
“জেলার সাহেব শুনে রাখুন, আসছে ফাগুন, আমরা হবো দ্বিগুণ।” পরে আমরা গেলাম জুড়ী বাজার।
সেখানেই এক ছোট স্মৃতি:
আমার পায়ে ছিল স্যান্ডেল, ভারী ব্যাগ কাঁধে। বৃষ্টিতে হাঁটতে পারছিলাম না, জুতা খুলে গেল। মাহফুজ ভাইয়া আর আব্দুর রব ভাইয়া আমার ব্যাগ আর জুতা হাতে নিলেন। এটাই হয়তো ছোট ঘটনা, কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে এইটুকু সহমর্মিতা আমাকে কাঁদিয়ে দিয়েছিল।
সমাপনী বক্তব্যের সময় পুলিশ আবার আসে, তখন ছাত্রলীগ হঠাৎ আক্রমণ করে। সবাই দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করবো।
দৌড়ে লন্ডন প্লাজায় গেলাম, চাচ্চুর দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। সাথে এক পিচ্চিও ছিল—ভয়ে কাপছিলো। দোকানের গেট বন্ধ, ছাত্রলীগ গালাগালি, হাতে দা। একা মেয়ে হয়ে ওই দোকানে আমি যেন জমে গিয়েছিলাম। পরে মারুফ ভাইকেও দেখলাম, আমি উনাক বললাম- “এইটা কেমন জুড়ী? আমি কি চোর? আমরা কি ভুল করছি?”
পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে আব্বুকে ফোন দিলাম, উনি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। বাসায় তখনই জানা গেল সব কিছু- লাইভ, ছবি, নিউজ… আমি ভাইরাল!
মেজো আব্বু ফোন দিলেন- বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যা, পুলিশ আসবে।রাতের বেলা বাবা দরজা খুলে দেখেন পুলিশ গাড়ি। নিশ্চিত না হলেও আতঙ্কে আমাকে উপরের ফ্ল্যাটে লুকানো হলো।
সকালে বাবা আওয়ামী লীগ অফিসে ডাকা পড়লেন- সেখানে তাঁকে হেনস্তা করা হলো, বাধ্য করা হলো বলতে “মেয়ে ভুল করে আন্দোলনে গিয়েছিল।”
বাবা যখন বাসায় ফিরলেন, বললেন,“১৯ বছরে এই প্রথম, তোর কারণে মানুষের সামনে এত কথা শুনলাম।”
আমি তখন আর চোখ তুলেও তাকাতে পারিনি। প্রতিজ্ঞা করলাম-এই জুড়ীতে আর কোনোদিন পা রাখবো না।
আগস্ট আমি রাতভর আল্লাহর কাছে কেঁদেছিলাম।
৫ আগস্ট হঠাৎ শুনলাম- শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন।চারদিকে আনন্দ, উল্লাস, বিজয়ের আবেশ।
হয়তো সব বদলায়নি- জুড়িও না, দেশও না। কিন্তু আমি জানি, যখনই দেশে স্বৈরাচার জন্ম নেবে, তখনই আবার ফিরে আসবে একেকটি 'জুলাই'।
আজ যারা মেয়েদের অবদান ভুলে গেছেন, তাদের বলি- ৩ আগস্ট যখন আপনারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে ছিলেন, তখন মেয়েরাই ছিলো সামনের কাতারে। আর সেই ভাইয়ারা, যারা পাশে ছিলেন- তাদের ইতিহাস কোনোদিন ভুলবে না।
লেখক: লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট।
জুড়ীরসময়/ডেস্ক/সাইফ