খোর্শেদ আলম::
লোকালয় থেকে ৭ কিলোমিটার বনের গভীরে পড়ে ছিলো আজগরটির নিথর দেহ। চলতি মাসের ৫ তারিখ বনে বিশাল আকৃতির অজগর সাপের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে জানাজানি শুরু হয়। ঘটনাটি ঘটে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের চেলার হান্ডর নামক এলাকায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৫ দিন আগে অজগরটি গবাদিপশু বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী খেয়ে পড়ে থাকে। অজগরের পেট খাবারে ভর্তি থাকায় তাৎক্ষণিক নড়াচড়া করতে পারে নি। মারা যাওয়ার পরে বন বিভাগ, গণমাধ্যমের মাধ্যমে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পরে বন বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুনা যায় নি।
খবরটি জানাজানি হলে গত রবিবার (৮ অক্টোবর) ঘটনাস্থল চেলার হান্ডরে মৃত অজগরটিকে দেখতে যায় স্থানীয় 'পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের কয়েকজন সদস্য।
পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য আবিদ হোসাইন ও জেবলু আহমেদ সাথে কথা হলে তারা বলেন, লোকালয় থেকে ৭/৮ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়ে আমরা ঘটনাস্থল বনের গভীরে সুরমা বাঁশ মাহালের একটি অংশে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই অর্ধগলিত বিশাল আকৃতির অজগরটির মৃতদেহ পড়ে আছে। এটি প্রায় ৮ থেকে ৯ ফুট লম্বা হবে। আমরা যাওয়ার রাস্তায় মানুষের চলাচলের বেশ কিছু আলামত পেয়েছি। সাথে বনের বড় একটি অংশ পরিস্কার করে রাখা। অজগরটি দেখা বুঝা যাচ্ছে বড় কোনো প্রাণী খেয়ে পড়ে আছে। সাথে অজগরের গায়ে আঘাতের চিহ্নও দেখতে পাই।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় অবস্থিত লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন। এই বনের আয়তন ৫ হাজার ৬ শত ৩১ দশমিক ৩০ একর। নিবিড় পর্যাবেক্ষণে এই বনে সম্প্রতি নতুন কয়েক ধরনের বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এটি সিলেট বিভাগের অন্যতম চির হরিৎ বন। সংরক্ষিত এই বনে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও মানছেন না কেউই। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের নজরদারিও কম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনে নিয়মিত যাওয়া আসা করা স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমরা অনেক সময় বন বিভাগের জন্য মুখ খুলে বলতে পারি না। যদি বলি পরে বন বিভাগ আমাদের উপর বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ করে। তবে এই সাপটি মরেনি। সাপটিকে বনে ভেতরে পিঠিয়ে মারা হয়েছে। এখানে বনের ভেতরে অনেকেই গরু চরায় ও বাগান পরিচর্যা করে। তারা বলাবলি করেছে এই সাপটি যখন এতো বড় প্রাণী গিলে ফেলছে নিশ্চয়ই গরুও খেতে পারবে। এই চিন্তায় হয়তো যারা গরু রাখে বা বাগান পরিচর্যা করে তারাই মারতে পারে।
প্রতিবেদকের কাছে ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সংরক্ষিত আছে। সেখানে দেখা যায় স্থানীয় বেশ কয়েকজন মিলে সাপটিকে বনের ঝোপঝাড় থেকে লেজ ধরে টেনে হিঁচড়ে একটু বাহিরে বের করতে জোর পূর্বক চেষ্টা করছে। আবার, সাপটি মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য বনের দিকে জোর করে যাওয়ার চেষ্টা করতেছে। তারা সাপটির গায়ে লাঠিটিসোটা দিয়ে আঘাত করেছে। ভিডিওতে শুনা যাচ্ছে কেউ বলছেন, মারো বাড়ি (আঘাত করো)।
সেচ্ছাসেবী পরিবেশবাদী সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য আবিদ হোসাইন বলেন, অজগরের মৃত্যুর খবর শুনে আমি সহ টিমের আরও সদস্যরা গিয়েছিলাম ঘটনাস্থলে। দেখা যায় মৃত সাপটি প্রায় ৭০শতাংশ পঁচে গেছে। এবং শেষ বারের মতো খাওয়া বুনো শুকরের হাড় দেখা যাচ্ছে। এখানে এসে যা দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে না সাপটি এমনি মারা যায়নি। এখানকার পরিবেশ বলছে এটা পরিকল্পিত ভাবে মারা হয়েছে।
সাপ গবেষক বোরহান বিশ্বাস রুমন বলেন, বাংলাদেশের এই আঞ্চলে যে অজগর গুলো পাওয়া এগুলো হলো বার্মিজ পাইথন। এরা কোন ভাবে মানুষ কিংবা গরুর মতো প্রাণী খাওয়া সম্ভব না। সাপ যখন খাবার খায় তখন হজম করার জন্য ৭২ ঘন্টা সময় নিবে। খাবার যদি একটু বড় সাইজের হয় তখন অজগরের জন্য কোনো কোনো সময় ৫ থেকে ৬ দিনও সময় লাগতে পারে হজম করার জন্য।
তিনি বলেন, বন্য শুকরটা স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে সাইজে একটু বড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষ যদি তাকে বিরক্ত করে তাহলে সাপ বমি করার চেষ্টা করে এবং মারা যেতে পারে। এই সাপটাকে আঘাত করা হয়েছে এটা স্পষ্ট! তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাপের পেটে খাবার থাকায় সে পালাতে পারেনি। এটা সাপের জন্য খুব নাজুক অবস্থা।
জুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইন বলেন, সাপটি মারা যাবার খবর পেয়ে আমার ডিএফও স্যারের সাথে যোগাযোগ করেছি। ওনি আমাদের যেভাবে বলেছেন আমরা সেভাবে কাজ করেছি। তবে সাপটি কিভাবে মারা গেছে বিষয়টি আমরা স্পষ্ট নয়। প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, ঐ সময় আবহাওয়া খারাপ ছিল। আমাদের লোকবল কম থাকায় যার জন্য আমরা কিছু করতে পারিনি। আমাদের সোর্স থেকে সাপটিকে মারা হয়েছে এমন কোন তথ্য পাইনি। বিষয়টি নিয়ে থানায় জিডি হয়েছে, তদন্ত চলছে।
বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এটা সংরক্ষিত বন। বিষয়টি স্থানীয় বিট অফিসার আমাদের জানিয়েছেন। এবং বিট অফিসার বলেছে প্রাকৃতিক কারণে বা ওভারইটিংয়ের কারণে সাপটি মারা গেছে। আমার কাছে যে ছবি পাঠানো হয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে ওভারইটিং এর কারণে সাপটি মারা যেতে পারে। সাধারণত সাপকে মারা হলে থেথলে যায়। ছবিতে এরকম কিছু চোখে পড়েনি। ছবি দেখে যা আমার কাছে মনে হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে থানায় একটি জিডি হয়েছে। সাপটিকে যদি পিটিয়ে মারা হয় তাহলে থানায় নিয়মিত মামলা হবে।
জুড়ীরসময়/কেআ/সাইফ