খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগ

খালেদ মাসুদ:

১৯৭৫ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে নিয়ে আসে কালো মেঘ। উলট পালট হতে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক আবহ।হত্যা,অভ্যূত্থান,পালটা অভ্যূত্থান। এ যেনো গা শিহরে উটার মতো অবস্থা। দেশের পরিস্থিতি কিংবা রাজনৈতিক আবহ কোন দিকে কখন গতি নেয় তা বুঝে উঠা দুর্স্কর হয়ে পড়ে।

১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে শহীদ করার পর বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা দখল করেন খন্দকার মোশতাক। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারে তিনি পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে তিনি বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বাকশালের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের পিছনে খন্দকার মোশতাক ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA জড়িত বলে মনে করেন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। তবে সিআইএ জড়িত কিনা তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে ছিলেন। খন্দকার রশিদই মূলত ঘাতক সামরিক অফিসারগণ ও মোশতাক-চক্রের সাথে সমন্বয় রক্ষা করেন। মুজিব হত্যার আরেক মূল পরিকল্পনাকারী ঘাতক কর্নেল ফারুক রহমান এক সাক্ষাতকারে বলেন, রশিদই প্রথম তাকে সরকার উৎখাতের কথা বলেছিল। "মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র" বইয়ে লেখক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত লেখেন, বাকশাল গঠন নিয়ে তিনি তাজউদ্দীন আহমদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন, ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই আওয়ামী লীগের চার পাঁচজন সদস্য এই পরিকল্পনা করে, খন্দকার মোশতাক জেদ্দায় গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন, এবং মোশতাক যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফস্টারের সঙ্গেও এ ব্যাপারে গোপনে আলোচনা করেন এবং মার্কিন দূতাবাস ব্যাংক থেকে এজন্য তাদের কাছে তিন কোটি টাকাও আসে। তাজউদ্দীন আরও বলেন, পরিকল্পনায় বিদেশি সহায়তার অন্যতম কারণ ছিল আমেরিকা সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, এবং সৌদি আরব, জর্ডান ও লিবিয়াসহ ইসলামী দেশগুলো ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছিল না, তাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হোক। এছাড়াও আমেরিকার সি.আই.এ. ও রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মুজাফফর)ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের পরিবর্তে তাদের নিজেদের অনুকূলে সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করতে চাইছিল, তাজউদ্দীন এ বিষয়টিকে নিজ ভাষ্যে বলেন, "ভারত ছাড়া পৃথিবীর এগারটি বৃহত্তম শক্তিই চাইছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম বানাতে। এবং তাদের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছে এই দেশ।

তবে আশ্চার্য জনক বিষয় হলো,বঙ্গবন্ধু হত্যায় ১৪ জন আর্মি অফিসার ও ১০০-৭০০ জন সেনা সদস্য অংশ নেয়।ততকালীন সেনাপ্রধান  কে. এম. শফিউল্লাহ ভুমিকা রহস্যময়। তিনি কি জানতেন না, কিংবা গোয়েন্দা বাহিনী থাকা সত্ত্বেও সেনানিবাসের ভেতরকার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন না। সেই রাতে মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা এই নারকীয় ঘটনা ঘটায়।সেই রাতে সেনা কিংবা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রক্ষীবাহিনী কোনো কাজে আসলো না।বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিবাদে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী ১৭হাজার মুজিব ভক্ত নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন। এছাড়া গুটিকয়েক জায়গা ছাড়া কোথাও আওয়ামী লীগের বা সাধারণ মানুষরা প্রতিবাদ করতে দেখা যায় নি।

বরং খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার প্রায় সবাই শপথ নেন।এর মধ্যে খন্দকার মোশতাক নিজেই ছিলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। ২ জন উপদেষ্টা, ১ জন উপ-রাষ্ট্রপতি, ১১ জন মন্ত্রী, ১০ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে গঠিত হয় মোশতাক মন্ত্রীসভা।

উপদেষ্টা ছিলেন

 ১.জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী -প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা।

২.মির্জা নূরুল হুদা -কৃষি, বাণিজ্য, অর্থ, শিল্প ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

*মোহাম্মদউল্লাহ ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি। যিনি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী সভার সদস্য ও ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

১.আবু সাইদ চৌধুরী, ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার বন্দর ও নৌপরিবহন মন্ত্রী ছিলেন।

২.এম.ইউসুফ আলী, ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম মন্ত্রীসভায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী তিনি। পরে সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠন হলে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৯৭৫ সালে বাকশাল মন্ত্রীসভায় শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি বাকশালের শ্রমিক ফ্রন্ট পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন।

৩.ফণী ভুষন মজুমদার,ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার খাদ্য মন্ত্রী। 

৪.সোহরাব হোসেন,ছিলেন গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার বন, মৎস্য ও পশু পালন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী।

৫.আব্দুল মান্নান,ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্র ও পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন।

৬.মনোরঞ্জন ধর,ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার ও আইন মন্ত্রী ছিলেন। 

৭.আব্দুল মুমিন,ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়,খাদ্য মন্ত্রণালয়,সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার খাদ্য ও বেসামরিক সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। 

৮.আসাদুজ্জামান খান, ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার পাটমন্ত্রী ছিলেন।

৯.এ আর মল্লিক,ছিলেন অর্থ মন্ত্রী।

১০.মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভারও শিক্ষা মন্ত্রী। 

প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যারা ছিলেনঃ-

১.শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ছিলেন বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী ও তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সরকারের হুইপ এর দায়িত্ব পালন করেছেন।

২.দেওয়ান ফরিদ গাজী,ছিলেন বানিজ্য ও খনিজ প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

৩.তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ছিলেন তথ্য, শ্রম ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

৪.নুরুল ইসলাম চৌধুরী,ছিলেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার প্রথমে শিল্প ও পরে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

৫.নুরুল ইসলাম মঞ্জুর,ছিলেন যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভারও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী।

৬.কে এম ওবায়দুর রহমান,ছিলেন ডাক প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার ডাক ও তার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

৭.মোমেন উদ্দিন আহমেদ,ছিলেন পানি প্রতিমন্ত্রী  ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। 

৮.মোসলেম উদ্দিন ছিলেন পাট প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার ও পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। 

৯.ডা.ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল,ছিলেন কৃষি ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

১০.রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ,ছিলেন বন প্রতিমন্ত্রী। 

১১.সৈয়দ আলতাফ হোসেন,ছিলেন যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার রেলওয়ে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

এছাড়াও বঙ্গবন্ধু সরকারের ডেপুটি স্পিকার আব্দুল মালেককে স্পিকার মনোনীত করেন খন্দকার মোশতাক।মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় সিপাহি জনতা বিপ্লবীরের মাধ্যমে মোশতাক ও তার মন্ত্রী সভার পতন হয়।

জুড়ীরসময়/ডেস্ক/এএ