চা শ্রমিক দিবস ও তাদের গৌরবের ইতিহাস

চা শ্রমিক দিবস ও তাদের গৌরবের ইতিহাস


আব্দুল্লাহ জহুরী::

যাদের রুক্ষ হাতের স্পর্শে শোধিত হয়ে, আমাদের রোজগার ক্লান্তি দূর হচ্ছে সে সকল চা শ্রমিকদের দিবস আজ। 

বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত চা বাগান শুধুমাত্র প্রকৃতির শোভা বর্ধন করছে না, বরং দেশের অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এসব চা শ্রমিকরা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এছাড়া তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে তুমুল আগ্রহ অনেকের, প্রকৃতির সবচেয়ে শ্যামলে এদের বিচরণ, অথচ তাদের জীবন তাদের স্বীয় হাতগুলোর মতোই মলিন। সবকিছুর বাইরে গিয়েও তাদের রয়েছে অস্তিত্বের ইতিহাস। এছাড়া তাদের ইতিহাস, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়েও লোকের কৌতুহলী প্রবল।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। বাংলাদেশে চা চাষের সূচনা হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, ১৮৪০-এর দশকে। প্রথম চা বাগান গড়ে ওঠে সিলেটের মালনীছড়ায় ১৮৫৪ সালে। চা চাষে দক্ষ শ্রমিকের অভাব থাকায় ব্রিটিশরা ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড ও মধ্যপ্রদেশ থেকে চুক্তিভিত্তিক চা শ্রমিক আনেন। এদের ‘আদিবাসী’ বা ‘ট্রাইবাল’ বলা হতো। এরা মূলত সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাঁও, ভীল, খড়িয়া ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ছিলো। প্রতারণার মাধ্যমে এসব শ্রমিকদের এনে বাগান এলাকায় বসতি গড়ে তোলা হয়। অনেকেই কোনোদিন আর নিজভূমিতে ফিরতে পারেননি।

তারা আজও “বাঁধা শ্রমিক” বা “চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক” হিসেবে বিবেচিত হন—যদিও প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে। 

১৯২১ সালের ২০ মে ছিল উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের নির্মম ইতিহাসের করুণ অধ্যায়। সেদিন সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক তাদের অমানবিক জীবন, নিপীড়ন ও শোষণের শৃঙ্খল ছিঁড়ে নিজের জন্মভূমির দিকে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে রওনা হন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এই আত্মমর্যাদার যাত্রাকে সহ্য করতে পারেনি। চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে ব্রিটিশদের নির্দেশে পুলিশ তাদের উপর গুলি চালায়। অনেক নিরস্ত্র চা-শ্রমিক সেই গুলিতে প্রাণ হারান। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল শুধুই শোষণের নির্মম প্রদর্শন। সেই ভয়াল দিনের স্মরণে চা-শ্রমিকরা প্রতি বছর ২০ মে দিনটিকে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন—শ্রদ্ধা জানাতে তাদের পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে।


চা শ্রমিক দিবসে সম্পর্কে জানলাম, এখন একটু আলোকপাত করা যাক তাদের বর্তমান আর ভবিষ্যতে।  শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন ভীষণ কষ্টসাধ্য। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০–২৩ কেজি পর্যন্ত চা-পাতা তুলতে বাধ্য হন। এক কেজি পাতার জন্য তারা পান মাত্র কয়েক টাকাই। ২০২২ সালে শ্রমিকদের দাবির মুখে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করা হয়—যা কখনোই জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

বাগানে শ্রমিকদের বসবাসের জায়গা অত্যন্ত অনুন্নত, অস্বাস্থ্যকর। অধিকাংশ বাগানে পাকা ঘর নেই, নেই প্রয়োজনীয় শৌচাগার, চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ। নিজ খরচে ওষুধ কিনে চিকিৎসা নিতে হয় শ্রমিকদের। বাগান এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা নগণ্য। অধিকাংশ শ্রমিক পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে না। শিক্ষার অভাবে ভবিষ্যতেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম শ্রমিক হিসেবেই থেকে যায়। এসব নিয়ে তাদের আন্দোলনও কম হয়নি, কিন্তু কোন ফল মিলছে না। তাদের জীবন একটা চক্রের মতো, একি গতিতে একই কক্ষপথে আবর্হিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, চা শ্রমিকরা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং অস্থির জীবনের উত্তরাধিকার বহন করে চলবে। শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টি ও সুযোগ বঞ্চনার কারণে তারা ভবিষ্যতেও শ্রমিক হিসেবেই আটকে থাকবে—অভিজ্ঞান নয়, বেছে নেওয়ার সুযোগ ছাড়াই। 

আবার কিছুটা বৈপরীত্যে দেখা যায়, অনেক চা শ্রমিক আরেকটু উন্নত জীবনের আশায় বাইরের শ্রমিক শ্রেণির সাথে কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এরকম চলতে থাকলে, শ্রমিকের সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশ মতো উন্নয়শীল দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পের একটি সংকটে পড়লে, পুরো দেশের অর্থনীতি হীনপ্রাপ্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে৷ দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অসম্মান, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎহীনতা থেকে হতাশা জন্ম নিচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই মাদকাসক্ত। তারা যেহেতু দেশে'র মূল জনগণের অংশ, তাদের অধোগতি দেশে'র সার্বিক উন্নয়নের প্রভাব ফেলবে। 

চা শ্রমিক'রা আমাদেরই সংস্কৃতির অংশ, তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন সহ বাকি দাবিগুলো মেনে নিয়ে একটা সুরক্ষিত জীবন তারা পাবে এই প্রত্যাশা। সবাইকে চা শ্রমিক দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষার্থী, মৌলভীবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।

জুড়ীরসময়/ডেস্ক/সাইফ