খালেদ মাসুদ::
১. গোটাবায়া রাজাপাক্সা (শ্রীলংকা): ভারত মহাসাগরীরের মাঝে নান্দনিক সুন্দর দেশ শ্রীলঙ্কা।গৃহযুদ্ধ দেশটাকে অনেক ভুগিয়েছে। কিন্তু তারা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে।এদিকে ২০২০ সাল করোনা দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা করে দেয় পর্যটন শিল্প নির্ভর দেশতাকে। চরম অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে গত মার্চে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় বিদ্যুৎ ঘাটতি ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামবৃদ্ধির ক্ষোভ প্রকাশ করতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিক্ষোভের মুখে গত ২০২২ সালের ৯ মে রাজাপাকসের বড় ভাই মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। তখনও গোটাবায়া রাষ্টপতি হিসেবে থাকেন। কিন্তু বিরুদ্ধেও চলতে থাকে বিক্ষোভ। ফলে ৯ই জুলাই তার পতন হয় ও ১৩ই জুলাই অতি গোপনে শ্রীলংকা ত্যাগ করে মালদ্বীপে চলে যান।সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে যান।
২.ভিক্টর ইয়ানকোভিচ (ইউক্রেন): সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে বিছিন্ন হলেও ইউক্রেন নিয়ে চলতে থাকে রুশ নেটোর স্নায়ুযুদ্ধ। কখনও পশ্চিমা ঘেঁষ বা কখন রুশ মদদপুষ্ট সরকার বসেছে ইউক্রেনের মসনদে। ২০০৪ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন ভিক্টর ইয়ানকোভিচ ,কিন্তু ভোট জালিয়াতি হুমকি দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠায় ইউক্রেন সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন ভিক্টর ইয়ানকোভিচ। সেটা সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়।বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার দুর্নীতি বৃদ্ধিসহ রাশিয়ার চাপে ইইউর সাথে ২০১৩ সালে নভেম্বরে হঠাৎ এসোসিয়েশন চুক্তি বাতিল করে ও রাশিয়ার সাথে বানিজ্য চুক্তি ও ঋন বেল আউটের সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরুদ্ধে শুরু গন আন্দোলন। এই আন্দোলন ১০০ জনের অধিক আন্দোলনকারী নিহতে হলে ইউক্রেন গৃহযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়।গন আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পালিয়ে যান ভিক্টর ইয়ানকোভিচ। প্রথমে খারকিভ পরে ক্রিমিয়ায় পালিয়ে যান এই রুশপন্থী সরকার প্রধান।
৩. ইদি আমিন (উগান্ডা): ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত যেসব সরকার প্রধান তাদের লিস্টে ইদি আমিন সবার উপরে থাকবেন। নিজে হাতে নিজের জনগণের রক্তে লাল করতে কোনো দ্বিধা করে নাই। সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসা ইদি আমিন আফ্রিকার অবহেলিত দেশ উগান্ডার সাবেক স্বৈরশাসক।২৫ শে জানুয়ারি ১৯৭১, প্রধানমন্ত্রী তখনসিংগাপুরে রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যস্ত, ইদি আমিন ঘটালেন সামরিক অভ্যুত্থান। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং শুরু হয় উগান্ডার ইতিহাসের অন্ধকারময় এক অধ্যায়ের।দেশের পুলিশ বাহিনীকে অপসারণ করে সৃষ্টি করেন নিজস্ব প্রহসনের বাহিনী। শুরু করেন হত্যাকাণ্ড, বিরোধী হত্যাকাণ্ড নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করেন।গ্রেপ্তার পরবর্তীতে নির্মমভাবে হত্যা করে। মৃত লাশগুলো উন্মুক্ত স্থানে ঝুলিয়ে রেখে জনমনে ভয়ের সঞ্চার সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রায় ১০,০০০ সাধারণ ও আমলা হত্যা করেন। এছাড়া অর্থনীতি ছিলো লাগাম ছাড়া। ১৯৭৮ সালে তানজানিয়ার সাথে বিরোধিতা শুরু হয় সঙ্গে দেশে গৃহযুদ্ধ। এক পর্যায়ে ইদি আমিন তানজিনিয়ার আক্রমণ করে বসে।প্রতিরোধ গড়ে তোরে তানজানিয়া। তাদের সাথে যোগ দেয় উগান্ডার ক্ষুব্ধ জনগণ। সম্মিলিত প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় আমিন বাহিনী। পিছু হটতে শুরু করে সেনাবাহিনী। শান্তির প্রস্তাব দিলে তানজানিয়া তা প্রত্যাখান করে বিভিন্ন শহর দখল করতে থাকে।এক পর্যায় ইতিহাসের কুখ্যাত এই শাসক লিবিয়ায় পালিয়ে যায়। তার শাসন আমলে ধারণা করা হয় প্রায় ১লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ২০০৩ সালে সৌদি আরবে মারা যায় ইদি আমিন।
৪.আশরাফ ঘানি (আফগানিস্তান): মার্কিন সর্মথিত সাবেক আফগান শাসক আশরাফ ঘানি। ২০০৯ সালের রাষ্টপতি নির্বাচনে ৪র্থ স্থানে থাকা ঘানি ২০১৪ সালে এক বির্তকিত নির্বাচনে আফগান মসনদে বসেন। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘানি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। ঘানি রাষ্ট্রপতি এবং আবদুল্লাহ প্রধান নির্বাহী হন, ক্ষমতা বিভক্ত অর্ধেক অর্ধেক। ২০১৯ সালের নির্বাচনে নানার স্বপ্ন দেখিয়ে বিজয়ী ঘানি। বলেছিলেন তালেবানের সাথে শান্তি স্থাপন করবেন।কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে ২০২১ সালে কাবুল বিজয়ের মাধ্যমে আফগান মার্কিন দখল মুক্ত করে মুজাহিদরা। তখন বিপুল পরিমান টাকা নিয়ে পালিয়ে যান এই মার্কিন মদদপুষ্ট আশরাফ ঘানি। বর্তমানে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করছেন।
৫.শেখ হাসিনা (বাংলাদেশ) : বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খুনি স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে সেনা সর্মথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে ক্ষমতায় বসে ভারত মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় বসে চেয়ার দীর্ঘস্থায়ী করতে পিলখানা হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ৫৭জন অফিসারদের শহীদ করা হয়। এরপর শুরু হয় বিরোধী মত দমনের অভিযান। হত্যা গুম মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করেন বিরোধীমতের নেতাকর্মীদের। নিজে তত্ত্ববাধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করলেও ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করে।ফলে ভোটারবিহীন নির্বাচন ২০১৪,২০১৮,২০১৪ সালে দেখে দেশ। দেশের ইতিহাসে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালান শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ৫ই মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীদের উপর রাতের আঁধারে নারকীয় হত্যাকান্ড চালানো হয়।এছাড়াও বিরোধী দলের নেতাদের হত্যা করা হয়। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতীয় স্বার্থের দিকে বেশি খেয়াল দেন শেখ হাসিনা। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা দেন। বিনিময় বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। মানুষের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। প্রথমে কোটা সংসারে আন্দোলন হলেও পরবর্তীতে তা এক দফা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের রূপ নেয়।ফলে ২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ছাত্র জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে পতন হয় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের। বিজয় হয় গণতন্ত্রের, বিজয় হয় বাংলাদেশের, বিজয় হয় লাখো শহীদের, বিজয় হয় মুক্তিযুদ্ধের।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটে। কিন্তু জালিম সরকার তা থেকে শিক্ষা নেয় না। ফলে ইতিহাসের মত তাদেরও পতন হয়। স্বৈরাচাররা নিজেদের খুব শক্তিশালী মনে করলেও তাদের পতন হয়।
লেখক: খালেদ মাসুদ, উপ-সাহিত্য সম্পাদক জুড়ীর সময়
জুড়ীরসময়/খালেদ/হোসাইন