তানজিমুল ইসলাম::
আজকাল বাংলার গ্রামগুলোতো আগের মতো মেঠোপথ দেখা যায় না। গরুর রাখাল আর আঁকাবাঁকা পায়ে হেটে চলার পথগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রতিবছর প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষার পর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠিত হতো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, সাইকেল খেলা, ফুটবল, ক্রিকেট প্রভৃতি। আজ তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে, গ্রাম বাংলার সেই সব অতীত ঐতিহ্য ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে,সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো।
পৃথিবীর অনেক জ্ঞানী-গুনী কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির আত্মজীবনীতেও রয়েছে এই শৈশবের স্মৃতিচারণ।
শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দলবেঁধে লুকোচুরি, চোর-পুলিশ, ফুটবল, ক্রিকেট খেলার মজাই আলাদা।
এই অগ্রহায়ন-পৌষ মাসে শৈশবকালের সবচেয়ে বেশি স্মৃতি বিজরিত।
আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম বছরের এই সময়টা ছিলো অত্যন্ত আনন্দের।
তখন আমাদের ক্ষেতের জমিগুলো বর্গাচাষে দেওয়া হতো। বর্গাচাষীরা ধানকাটা শুরু করলে ধানের আটিগুলো আামদের বাড়ির উঠোনে জমা করতেন।ধানগুলো জমানোর পর আলতো সূর্যের আলো ও কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেল বেলায় ধানগুলো গরু দিয়ে মাড়াই দেওয়া হতো।
তখনকার সময় গ্রামাঞ্চলে কিন্তু বিদ্যুৎ বা এতো আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না।
সন্ধ্যার পর হারিকেন, লেম (কুপিবাতি) ব্যবহার করে পৌষের শীতের রাতে মাড়াই দেওয়া হতো।
আামার পরিবার যৌথ ও রক্ষনশীল। পরিবারের সবাই খুব নিয়ম মেনে চলাফেরা করতো। বিশেষ করে মনে পড়ে মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর আমরা যারা শিক্ষার্থী ছিলাম তাদের পড়তে বসানো হতো। কিন্তু তখন আমি ও আমার বোন এবং চাচাতো ভাই বোনরা মিলে হারিকেনের মিটিমিটি আলোর মধ্যে রাতে বাহিরে বের হয়ে যেতাম এই ঐতিহ্যবাহী গরু দিয়ে মাড়াই কাজ দেখার জন্য তখনকার সময় যারা আমাদের বর্গাচাষ করতেন উনারা আমাদের খুব আদর স্নেহ করতেন। আামাদের বার বার বলতেন ঘরে যাও ঠান্ডা লাগবে, কিন্তু আমরা নাছোড়বান্দা বাহিরে থাকবো ঘরে যাব না।
অনেক রাত পর্যন্ত মাড়াই চলতো আর আমরা সাবাই মিলে এই গভীর রাত পর্যন্ত মাড়াই দেখতাম, মাড়াই কাজে সহযোগিতা করতেও মাঝে মাঝে চলে যেতাম, এই জন্য অভিভাবকদের কত বকা শুনতে হতো।
শীতের রাতে প্রচন্ড ঠাণ্ডাতে খড় জ্বালিয়ে দিতেন আমাদের বার্গাচাষীরা। আমরা সেই আগুনের পাশে বসে আগুনের তাপে ঠাণ্ডা নিবারনের চেষ্টা করতাম।
মাড়াই শেষে খড়গুলো যখন জমা করে রাখা হতো তখন সেই স্তুপের উপরে উঠে অন্ধকার রাতে আবছা আবছা আলোতে খেলা করতাম, শুয়ে থাকতাম।
দিনের বেলাও নিস্তার নেই স্কুল থেকে এসেই আবার ধান ও খড় নিয়ে খেলা শুরু। ঐ সময় আমি নিজে একদিন লুকোচুরি খেলতে গিয়ে একটা তুলকালামকান্ড করে ফেললাম।
একদিন দুপুরে লুকোতে গিয়ে খড়ের গাদার (তবে তখন খড় রাখার ঘর ছিল আমাদের) ভিতরে গর্তের মতো করে ঢুকে বসছিলাম।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। আমার বাবা, মা, দাদী, চাচা-চাচীসহ বাড়িরসুদ্ধ লোক খোঁজাখুঁজি শুরু করলো পুকুরসহ বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আমাকে খোঁজেছে। কিন্তু আমাকে খুজে পাওয়া যায়নি।
আমার বোন ও চাচাতো ভাই-বোনেরা তখন ছোট ওরা ও সঠিকভাবে কোন কিছু বুঝিয়ে বলার বোধশক্তি হয়নি তখনও।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আমাকে এক পর্যায়ে খড়ের গাদার ভিতরে পাওয়া গিয়েছিল।
এই ঘটনাটি ভয়ংকর হলেও এটা আমাকে বার বার শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
বিকেল বেলা পাড়ার বন্ধুরা ও আমরা সবাই মিলে নানান খেলায় মেতে থাকতাম। গ্রামের মেঠোপথ সহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতাম। সন্ধ্যা নেমে এলে বাড়ির পথে ছুটে চলা।
এসে আবার আগের দিনের নিয়মেই শুরু হতো আমার ঐ সময়ের শৈশবের বেশিরভাগ দিন।
বর্তমানে আমার শৈশব নেই তবুও এখনও গ্রামে আসলে গ্রামের বিভিন্ন মেঠোপথ আকাঁবাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। আমাদের বাড়িতে এখনো বার্গাদার দিয়ে বর্গাচাষ হয়, হাতে ধান কেটে বাড়িতে এনে জমা হয় ঠিকই কিন্তু মাড়াই কাজটা আগের মতো হয় না। আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে এখন আধুনিক মাড়াই মেশিন (ইঞ্জিন চালিত) দিয়ে ধান মাড়াই হয়।
আগের থেকে বিষয়টি সহজ হলেও অতীতের গরু দিয়ে যে মাড়াইয়ের আমেজ ছিল তা আর নেই। সবই যেন যান্ত্রিক।
আমি এই মৌসুমে শৈশবের একটু ছোঁয়া পেতে খড়ের গাদার উপর উঠে খেলাধুলা করেছি, ছবি তুলেছি। এই যান্ত্রিক জীবনে প্রকৃতি উপভোগ করতে বাড়ির অন্যান্য সদস্য ও শিশুদেরও উৎসাহিত করছি।
যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ যুগের শিশুদের শৈশব বলতেই সারাদিন পড়া না হয়, মোবাইলের স্কিনে সময় দেওয়া। শিশুর বয়স চার বছর হতে না হতেই এক গাদা বই দিয়ে দৌঁড়ানো স্কুলে।
স্কুল থেকে ফিরে শুরু কোচিং। এরপর কোচিংয়ের কাজ করতে করতে দিন রাত শেষ।
এখানে একটা কথা না বললেই নয় তা হলো বিজ্ঞান দিয়েছে অনেক কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ-অনুভূতি, মানুষের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করছে প্রকৃতির।
আমাদের উচিত পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে শিশুদের সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া।
যাতে করে দাদা-দাদি, নানা-নানি,মচাচা-চাচিসহ পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে নিয়ে শৈশবের একটি সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পারে তারা।
পরিবারের উচিত শিশুদেরকে গ্রামের পরিবেশের সাথে মেলা মেশার সুযোগ করে দেওয়া যাতে করে তারা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে।
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আমরা কী এইটুকু চেষ্টা করতে পারি না?
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, জুড়ীর সময়।
জুড়ীরসময়/তুহিন/হোসাইন