খোর্শেদ আলম::
মাত্র ২০ বছর বয়সী সুন্দর চেহারার অধিকারী টগবগে এক যুবক। মা-বাবার খুব আদরের সন্তান। অনেক স্বপ্ন অনেক আশা ছেলেটা বড় হবে, দেশে পড়ালেখা করে চাকরি করবে। কিন্তু এই দেশে তো স্বাধীনতা নেই, কথা বলতে হয় অন্যের ভাষায়। অন্য দেশের শাসন মতো চলা। কেমনে মেনে নেই এসব। সবাই দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছে। তখন চিন্তা করলাম আমিও যাবো যুদ্ধে। দেশকে স্বাধীন করবো। এ প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন আশরফ আলী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরফ আলী। ১৯৫০ সানের ১৩ জুলাই মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউপির নিশ্চিতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা ইনাম উদ্দীন (দলা মেছাব) ও মাতার নাম জুলেখা বিবি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বে তাঁর পিতা মাওলানা ইনাম উদ্দীন পূর্বজুড়ী ইউনিয়নের বড়ধামাই গ্রামে বসতবাড়ী নির্মাণ করে চলে আসেন। মাওলানা ইনাম উদ্দীনে ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরফ আলী জৈষ্ঠ। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমান তাঁর বয়স ৭৩ বছর। সংসার জীবনে ৩ ছেলে ও ৫ কন্যা সন্তানের জনক তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৪নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা আশরফ আলী বলেন, তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দাসত্বের জীবনযাপন করেছেন বাঙ্গালি জাতি। কোন ভাবেই তারা ক্ষমতা দখল দিবে না। তখন ছাত্র, শ্রমিক সহ অনেকেই একত্রিত হয়ে মিছিল বের করেছিলেন আমরা মিছিলে সম্পৃক্ত হই। স্লোগান শুরু হয় জিন্নার পাকিস্তান ভজিটিলা গুরুস্থান, আইয়োবের গালে জুতা মারি, ভুট্টুর গালে জুতা মারি, এহিয়ার গালে জুতা মারি এভাবে চলছিল। তখনি এই মিছিলে যারা ছিলেন তাদের উপর শুরু হয় বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেওয়া নির্যাতন। অনেকেই বাড়ীঘর ছেড়েও রেহাই পাননি। আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ ও আমাদের শত্রু হয়ে গেলেন। যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যে দিন ভারতের রওয়ানা দেই সেদিন বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি আসে। আমার বাবা তখন কান্নাকাটি করে বিদায় দেন। আসামের করিমগঞ্জ গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় সেখানে দীর্ঘ এক মাস প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে এসে নিজ নিজ থানায় কার্যক্রমের নির্দেশ দেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। সেই সময় ইন্দিরা গান্ধি কেঁদে কেঁদে বক্তব্য রাখেন তিনি বলেছেন, মুক্তিবাহিনী যারা নির্যাতিত হয়ে আমার আশ্রয় নিচ্ছে তারা আমারই সৈন্য আমি নিজে যুদ্ধ ঘোষণা দিলাম। মেজর দত্তের এই নির্দেশনায় হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করা শুরু হয়। আমরা মনে ভেবেছি আর প্রাণে বাঁচব না, সবাই এক সাথে যুদ্ধ শুরু করেছি শুরু হয় পাল্টা পাল্টি মারামারি। আমাদের সহপাঠী একজন তাদের গুলিতে গুরুত্বর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সে বলেছে আমি আর বাঁচবো না তোমরা আমার হাতের অস্ত্রটা নিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য পালিয়ে যাও। যুদ্ধের ব্যস্ততায় এর পরে আহত এই সহপাঠীর কি হয়েছে জানি না! জীবনের অন্ধকার সময় পার করেছি। দীর্ঘ ৯ মাসের মধ্যে ৭ মাস এভাবে ছিল। আমরা বেঁচে ফিরবো এই আশা কখনো করিনি। দেশ স্বাধীনের পরে আমরা যারা যুদ্ধ করেছি কখনও সবাই একত্রিত হলে সবাই সেই স্মৃতির কথা স্বরণ করে কান্না করতাম। এটি ছিল জীবনের এক কালো অধ্যায়। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার কয়েকজন সহপাঠী সরকারি সহায়তা না পেয়ে ভিক্ষা করেছে! কেউ কেউ টেলাগাড়ীও চালিয়েছে জীবনের শেষ সময়ে। শুনেছি এখন তাদের সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধাভাতা পাচ্ছে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকাকালিন সময়ে জীবনের সাথে দ্বিতীয় যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৪ নং সেক্টরে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ও আব্দুর রবের নেতৃত্বে সিলেট জেলার অংশবিশেষ মৌলভীবাজারে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। ৪নং সেক্টরের সরাসরি পরিধি ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর পর্যন্ত। যুদ্ধে অনেক বিভীষিকাময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার।
মুক্তিযোদ্ধা আশরফ আলী আরও বলেন, মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী, বড়লেখা সহ শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ করি। আমাদের সঙ্গে সবসময় গোলাবারুদ সহ একটি বন্দুক ছিল। আমরা বেশ কয়েকজন ছিলাম একটি দলে। ছেঁড়া পেন্টা আর পাতলা গেঞ্জি পরে দীর্ঘদিন পার করেছি। কোন কোন সময় ৩-৪ দিন পর্যন্ত চোখে ভাত দেখিনি! চোখ মুছে মুছে সেই সময়ের কষ্টের কাহিনী বলেছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে সব সময় একটি বেলচা (মাটি কাটার যন্ত্র), থালা, হাঁড়িপাতিল থাকতো। আমরা যখন রাতে ঘুমাতে যেতাম কখনও গর্ত করে কখনও জঙ্গলের ঝুপে তার মধ্যে কয়েকজন জন একসঙ্গে ঘুমাতাম। একদিন রাতে আমার এক বন্ধু গর্ত করতে থাকলে আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। এসময় একটি মাইন বিস্ফোরণ হয়ে আমার বন্ধুটি সেখানে মারাত্বক আহত হয়। আমিও গুরুতর আহত হই। সেই দিনটি আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। আমার পায়ে সেই ক্ষতের চিহ্ন এখনও মুছেনি। এমন আরও অনেক স্মৃতি আছে যুদ্ধের।
জুড়ীরসময়/ডেস্ক/হোসাইন