কুলাউড়ায় বানরের উৎপাত; বছর পেরোলেও খোঁজ নেয়নি বন বিভাগ!

কুলাউড়ায় বানরের উৎপাত; বছর পেরোলেও খোঁজ নেয়নি বন বিভাগ!


নিজস্ব প্রতিবেদক::

প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৃক্ষ নিধন, ধ্বংশ হচ্ছে বন। এতে খাদ্য ও বাসস্থান হারাচ্ছে বনে থাকা প্রাণীরা। এর ফলস্বরূপ কখনো ফল গাছে, কখনো ঘরের চালে, কখনো বা ধান ক্ষেতে। সকাল থেকে বিকেল, এভাবেই দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে বানরদল। বনে পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় বসৎবাড়িতেও হানা দিচ্ছে তারা। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকেরা। গত বছর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে স্থান পরিদর্শনের আশ্বাস দেন তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও বন বিভাগ আজ অবধি পরিদর্শন করেনি এই যায়গা। ফলে অসহায় কৃষকরা এখন চাষাবাদ বন্ধের আশংকায় । 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার আদমপুর এবং হিংগাজিয়া চা-বাগান এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য।

হতদরিদ্র কৃষকদের লাগানো শাক-সবজি ও ফলের গাছ নষ্ট করে দিয়েছে। ফলের গাছে বানরদের লাফালাফিতে ফল ঝড়ে পড়ছে মাটিতে। চা-বাগানের ভিতর প্রায় ৫০ একর জমি বানরদের দখলে। কৃষকরা কড়া পাহারায় রাখছেন ফসলি জমি। 

আদমপুর গ্রামের বাসিন্দা চন্দন বলেন, আমার বাড়ির খালি জায়গায় ফলানো সবজি বেশিরভাব নষ্ট হয়েছে বানরের উপদ্রবে। এখন বাজারে গিয়ে ৬০-৯০ টাকা প্রতি কেজিতে কিনতে হচ্ছে।  উঠানে লাগানো ফলের গাছের অধিকাংশ ফল ঝড়ে পড়েছে বানরের উপদ্রবে। তারা পেটের খোদায় এমন তান্ডব চালাচ্ছে বলে ধারনা করছেন।

স্থানীয় কৃষক উত্তম গোয়ালা, লক্ষীনারায়ন মির্ধা, দিলীপ, রনজিৎ, সনজিৎ জানান, ভোর সকালে বানরেরা হানা দিচ্ছে। তাই  ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে ধানক্ষেত পাহারা দিতে চলে যেতে হয়। তাদের বেশ কয়েকটি দল আছে। এখনো কয়েকটি দল চারিদিক থেকে আক্রমণ করে ধানের ক্ষেতে। তখন তাদের সংখ্যা ৪৫-৫০ হয়ে যায়। এই সময় তাদেরকে তাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। কয়েক পাশের ধানগুলো খেয়ে ফেলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আর বেশিদিন  চাষাবাদ করা যাবেনা বলে জানান তারা। 

হিংগাজিয়া চা-বাগানের বাসিন্দা রাজন কুমার জানান, এই এলাকায় কয়দিন পর পর দেখা যায়, একটি দলে ১৩-১৪টি মুখপোড়া বানর আছে। তারা বিদ্যুতিক তারের আশেপাশে লাফালাফি করে থাকে,  যে কোন সময় বৈদ্যুতিক তারে লেগে তাদের মৃত্যু হতে পারে। 

পরিবেশ কর্মি খোর্শেদ আলম বলেন, বন ছেড়ে লোকালয়ে বানর গুলো নিশ্চই অনিরাপদ। মানুষের সাথে সংঘাত ও বিদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের বনগুলো দিন দিন ছোট হচ্ছে, বিশেষ করে সিলেট বন বিভাগের উদ্যেগে করা সুফল প্রকল্পের জন্য বনের প্রকৃতিক গাছ কেটে কৃত্রিম বনায়ন করা হয়েছে। এসব কারণে বানর প্রজাতির প্রণীর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সেজন্য বন ছেড়ে বানর গুলো এখন লোকালয়ে প্রবেশ করে। বানর গুলো লোকালয়ে গিয়ে মানুষের চাষকৃত সবজি-ফলমুল পায় আর বনে ফিরতে চায় না। যদি বন্যপ্রাণী'রা হাতে তোলা খাবার পায় তখন তারা সহজে বন মুখি হবে না। এখন এলাকার মানুষকে সচেতন করতে হবে যাতে বানর গুলো'কে কেউ খাবার না দেয়। খাবার পেলে এরা আর বনে ফিরবে না।

বন্যপ্রাণী গবেষক শাবিত হাসান বলেন,  যে ৩ প্রজাতির হনুমান বাংলাদেশে পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে মুখপোড়া হনুমানের বিস্তৃতি সবথেকে বেশি। গত ৩ জেনারেশনে এদের বাসস্থান প্রায় অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে। বনের আসেপাশে জমি থেকে ধান বা অন্যান্য খাবার খেতে আশা একটা স্বাভাবিক ঘটনা হলেও পুরো পরিবার সহ বন থেকে বের হয়ে স্থায়ীভাবে লোকালয়ে চলে আশা মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। অধিক পরিমানে বন ধ্বংসের কারণে খাদ্য ও আসবস্থান এর শংঙ্কট, এছাড়াও শিকারের কারণে এরা বন থেকে বের হয়ে আসতে পারে। এদের চলাচলের জন্য যেহেতু নিদৃষ্ট এলাকা (home range) থাকে তাই বনের ভিতরে নিজেদের এলাকা উজাড় হয়ে যাওয়ার এরা লোকালয়ে চলে আসতে পারে।তবে এটা নিয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকতা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষি করার জন্য কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য তাদের বাসস্থানের জায়গা দখলে আসছে, হয়তো এর কারনে এমন হতে পারে। আর এটি ম্যানেজিয়াল একটি প্রক্রিয়া। এইগুলার শর্টকাট সামাধান দেওয়ার মতো নেই। আমরা একটি পর্যবেক্ষন টিম পাঠাবো।

উল্লিখিত বিষয়টি জানার পর মৌলভীবাজার রেঞ্জ অফিসার গোলাম সারওয়ার মুঠোফোনে ফোন দিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা এই ধরনের কয়েকটি কাজ হাতে নিয়েছি। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করবো। এলাকাবাসীকে বানরের চোখে চোখ রেখে না তাকানোর অনুরোধ করেন এবং তাদেরকে কোন ধরনের খাবার না দেওয়ার জন্য বলেন। 

জুড়ীরসময়/শুভ/হোসাইন