মেছো বাঘ, বাঘ নয়

বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার/ মেছো বাঘ, বাঘ নয়

আদনান আজাদ আসিফ::


শীতের সকাল, সেবার গিয়েছিলাম মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনে। খুব ভোরেই প্রবেশ করেছিলাম বনের ভেতরে। কাধে বড় লেন্সওয়ালা ক্যামেরা নিয়ে বনের গভীরে ছড়ার(ঝিরি) পাশদিয়ে হেটেই চলছি। হটাৎ দূর থেকে কানে গোঙ্গানির আওয়াজ ভেসে এলো।কিন্তু সামনে বাক থাকায় কিছু দেখা যাচ্ছে না।এতটুকু অনুমান করেছিলাম, বিড়াল জাতীয় কোন প্রাণী মারামারি করছে। আমি নিশ্চুপ হয়ে গুটি গুটি পায়ে এগুতে লাগলাম। অনেকটা কাছে যাওয়াতে ঘড়ঘড় শব্দ আরও জোড়ালো হতে লাগলো। আমি চুপিচুপি বাক অতিক্রম করে বামে উকি দেয়ার চেস্টা করলাম,দেখি ছড়ার ঠিক পাশে শুকনো বালিতে দুটি মেছো বিড়াল ঘড়...ঘড়, ঘড়ৎ  শব্দ করে..... যৌন সঙ্গম (ম্যাটিং) করছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে কাধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে তাক করতেই বিড়াল দুইটি আমাকে দেখে ফেলে ও নিমিষেই লাফ দিয়ে বনের ভেতরে পালিয়ে যায়।সেই মুহূর্তে আমি তাদের সঙ্গমের ছবি তুলতে ব্যর্থ হলেও দুজনের পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাকে আমার ক্যামেরায় ধারণ করতে পারি।

একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে বুনো অবস্থায় দুর্লভ এই প্রাণীর দুই-তিন সেকেন্ডের জন্য হলেও তাদের সঙ্গম করতে দেখা আমার কাছে পরম সৌভাগ্যর বিষয় বলে মনে হয়েছিল।

নিশাচর এই মেছো বিড়াল দেখার ও এদের জীবনযাপনের ছবি তোলার লোভে মৌলভীবাজারের হাইল হাওরে প্রতি বছর রুটিন করে আমি অনেকটা সময় কাটিয়েছি। এক সময় তো টানা একুশ টা রাত কাটিয়েছিলাম। দিনে ঘুমোতাম ও বিকেলের পর থেকে পুরো রাত অব্দি বিভিন্ন স্পটে পাওয়ারফুল টর্চ লাইট,মাথায় হেডল্যাম্প ও ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ লাইট লাগিয়ে নিজেকে আড়াল করে ওত পেতে কখনো বসে কখনো বা মাটিতে উপর হয়ে শুয়ে থাকতাম। এত শ্রম দেয়ার ফলে এদের পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করা,খাওয়া, সাঁতার কেটে বিল পাড়ি দেওয়া সহ অনেক দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হয়েছি ও তা নিজ ক্যামেরায় ধারণ করেছি।

এই প্রাণীটিকে দেশের অধিকাংশ মানুষ মেছো বাঘ নামেই চেনে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এরা বাঘরোল নামেই পরিচিত। আগে আমিও এদের মেছো বাঘ বলেই জানতাম।

কিন্তু প্রখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর রেজা খান স্যারের সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারি - (মেছো বিড়ালকে মেছো বাঘ নামে ডাকায় এর সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। এই বুনো বিড়াল কে বাঘ ভেবে মানুষ ভয়ে ও অকারণে এদের মেরে ফেলে।) স্যারের এই তথ্যের পর থেকে আমি নিজেও এদের আর বাঘ বলে সম্মোধন করি না।

মেছো বিড়াল এর ইংরেজি নাম Fishing Cat বৈজ্ঞানিক নাম - Prionailurus viverrinus (Bennett,1833) এরা আকারে গৃহপালিত বিড়ালদের চেয়ে অনেকটা বড়।শরীর ঘন পুরু লোমে আবৃত। পুরুষেরা আকারে স্ত্রীদের চেয়ে  বড় হয়ে থাকে। গায়ের রং ধূসর, সাথে বাদামি আভা আছে। পেটের নিচের রং সাদাটে। পুরা শরীরজুড়ে ছোপ ছোপ কালো  দাগ আছে। চোখের উপরে কপাল থেকে কানের দিকে কালো দুটি রেখা উঠে গেছে। গাল দুটি হালকা সাদাটে।
মেছো বিড়ালদের অনেকেই চিতা বিড়ালের সাথে গুলিয়ে ফেলে। দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও এদের নাক কিছুটা চওড়া,দাত বড়,কান গোলাকার আকৃতির ও অপেক্ষাকৃত ছোট।

এরা জলে ও স্থলে সমানভাবে তুখর শিকারি। সাধারণত খাল বিল নদী পুকুর ও জলাভূমি আছে এমন জায়গাতেই এদের বসবাস। সুন্দর বনে বেশ ভালো সংখ্যা তেই আছে। তবে বেশি স্রোত আছে এমন নদীর পাশে এদের বসবাস করার তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

এরা মাছ, সাপ, ব্যাঙ, ইদুর, পাখি, খরগোশ, গুইসাপ সহ মাঝারি সাইজের অনেক প্রাণী শিকার করে থাকে। সুযোগ পেলে গৃহ পালিত হাঁস মুরগিও ধরে নিয়ে যায়। পানির ধারে ঝোপ অথবা কচুরিপানার ভেতরে এরা ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ করে ঘাপটি মেরে শিকারের আশায় বসে থাকে। সুযোগ বুঝে থাবা দিয়ে মাছ ধরে। পানির নিচে ডুব দিয়েও মাছ ধরাই এরা বেশ পটু। এরা নিশাচর। দিনে ঘন ঝোপ, গাছের চওড়া ডালে অথবা গর্তে ঘুমিয়ে কাটায়। সূর্য ডোবার পরেই সাধারণত এরা শিকারে বের হয়। এলাকা ভেদে একটি পুরুষ বিড়ালের সীমানা ২০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। যার প্রতি ৪-৫ বর্গ কিলোমিটার এর ভেতরে এক একটি স্ত্রী বিড়ালের বসবাস।এরা এদের সীমানা নির্ণয়ের জন্য শরীর থেকে এক প্রকারের সুগন্ধি(ফেরোমন) নির্গত করে। স্ত্রী বিড়াল প্রায় ৭০দিন গর্ভধারণের পর এক থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা জন্মের নয় মাস পর্যন্ত মায়ের সাথেই থাকে। সাথে থাকে
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খাল বিল এ বাণিজ্যিক ভাবে  মাছ চাষ হওয়ায় এদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাছ চাষীদের খাল, বিল ও পুকুর থেকে এরা মাছ খায় বলে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ধাওয়া করে এদের পিটিয়ে অথবা বিষ টোপ ও ফাদ পেতে ধরে মেরে ফেলে । এছাড়া পানি দূষণ, জলাভূমি ভরাট করে চাষের জমি বা বাড়ি নির্মাণ করাও এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ।

লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার

জুড়ীরসময়/এএ/সাইফ