এম সাইফুর রহমানের ১১ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ



স্টাফ রিপোর্টার::

মৌলভীবাজারে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম সাইফুর রহমানের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে।

এ উপলক্ষে ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার এম সাইফুর রহমান গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দনে কোরআন খতম, মিলাদ মাহফিল দোয়া ও শিরনী বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে।

মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সাইফুর রহমান স্মৃতি পরিষদ ও মৌলভীবাজার বিএনপি নানা কর্মসূচি গ্রহন করেছে। সকালে এম সাইফুর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কবর জিয়ারত ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

এদিকে সাইফুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও মৌলভীবাজারের জেলা ও উপজেলার মসজিদগুলোতে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।

উল্লেখ্য ২০০৯ সালে ৫ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের নিজ বাড়ি বাহারমর্দন থেকে ঢাকায় যাওয়ার সময় ঢাকা-সিলেট মহা সড়কের ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার খড়িয়ালা নামক স্থানে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, দেশের উন্নয়ন, সিলেট বিভাগসহ নিজ জেলা মৌলভীবাজারে উন্নয়নে নিরলস কাজ করে গিয়েছিলেন। দেশের সার্বিক উন্নয়নে এক ব্যতিক্রমি ব্যক্তি ছিলেন। সর্বদা দেশ ও এলাকার সামগ্রীক উন্নয়নে সময় পার করতেন।

সাইফুর রহমান ১৯৩১ সালেরর ৬ অক্টোবর জন্মগ্রহন করেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতা আব্দুল বাছিরকে হারান। এর পর তাঁর তিন চাচা দেখভালের দায়িত্ব নেন। ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি মেট্রিক (ঝঝঈ) পাশ করেন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমেডিট (ঐঝঈ) পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরের বছর ১৯৫৪ সালে তিনি চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টএ পড়ার জন্য লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি ইংল্যান্ড ও ওয়েলস এর চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৫৯ সালে উত্তির্ণ হয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করেন। এর পর তিনি অর্থবিষয়ক এবং উন্নয়নমূলক অর্থনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন।

সাইফুর রহমান মন্ত্রিত্বের প্রথম দিক অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রীর দ্বায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী ১২ বছর তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮১ সাল দুই বার, ১৯৯১-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ৫ বার এবং ২০০২-২০০৬ সালে ৫ বার সহ দীর্ঘ ১২টি বাজেট একজন সফল অর্থনীতিবিদ হিসেবে পেশ করে উপমহাদেশ সহ তথা গোটা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেন।

এম সাইফুর রহমানকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এতই ভালবাসতেন, যে কারণে শহীদ জিয়া বারবার তাগিদ দিয়েছেন রাজনীতিতে আসার জন্য। পরে তারই আমন্ত্রনে রাজনীতিতে যোগদেন।

রাজনীতিতে যোগদানের আগে এম সাইফুর কিছু উন্নয়নের শর্ত বেঁধে দেন। শর্ত মেনে নেয়ার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আস্বস্থ করলে ও সিলেট সহ দেশের উন্নয়নে কিছু করতে পারবেন সেই বিবেচনায় রাজনীতিতে অনুষ্ঠানিক ভাবে প্রবেশ করেন ১৯৭৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর।

ব্যক্তিগত জীবনঃ সাইফুর রহমান, দুররে সামাদ রহমানকে বিয়ে করেন। তাদের তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান রয়েছে। ২০০৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দুররে সামাদ রহমান মারা যান। তার পুত্র এম নাসের রহমান বাবাকে অনুসরণ করে রাজনীতিতে আসেন। ২০০৩ সালের নির্বাচনে তিনি বাবার ছেড়ে দেয়া মৌলভীবাজার-৩ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


স্বীকৃতি ও সম্মাননাঃ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় ৪ দিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এম সাইফুর রহমান। তৎকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষে মুচলেকা দিলে মুক্তি দেওয়া হবে জানানো হয়। কিন্তু শর্তে রাজী না হওায় কারাভোগ করেন ভাষা আন্দোলনকারী নেতা এম সাইফুর রহমান। তার এই অসামান্য অবদানের জন্য সর্বোচ্চ সম্মাননায় ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৪ সালে, তিনি স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হন।

দেশের সামগ্রীক উন্নয়নের পাশাপাশি নিজ জেলা মৌলভীবাজারের উন্নয়নে ছিল তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। সব সময় ভাবতেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে কিছু করার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য সাইফুর রহমানের নিরলস প্রচেষ্টা ছিল দেশেরে উন্নয়নের চালিকা শক্তি। ৯০ পরবর্তী দেশের অর্থনীতি এক নাজুক পরিস্থিতির সম্মূখীন ছিল। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী অর্থায়নে অভ্যন্তরীন অবদান প্রায় শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়। বৈদেশিক সাহায্যও ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ভঙ্গুর এ অর্থনীতি থেকে উত্তরনের জন্য তিনি নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণে করেন। তিনি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মূল্য সংযোজন করের আওতায় রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

বর্ষিয়ান নেতা এম সাইফুর রহমান ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে অর্থাৎ মৃত্যৃর বছর খানেক আগে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সর্বস্থরের মানুষের ভালবাসার মধ্যে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি নিজ নির্বাচনী এলাকা সিলেটের উন্নয়নে ছিলেন জাগ্রত।

বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড় করানো ছিল সাইফুর রহমানের অগ্রনী ভূমিকা। তিনি দেশের রাজস্ব আদায়ের পরিমান পৃথিবির উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক পিছনে রয়েছে বলে এক বাজেট অধিবেশনে উল্লেখ করেন। যে কারণে তিনি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধির উপর জোর দেন।

এম সাইফুর রহমানের রেখে যাওয়া রাজস্ব আদায়ের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে দেশের উন্নয়ন সহ অর্থনীতি শক্তভীতে দাঁড়িয়েছে। দেশকে যেভাবে ভাল ভাসতেন সেভাবে তার নিজ জন্মস্থানকে ভাল ভাসতেন। মানুষের ভালবাসা, মমতার মধ্যেই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন বর্ষিয়ান এই নেতা। সিলেটের মানুশের প্রতি এতই ভাল ভাসা ছিল, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে কান্না ভরা কন্ঠে আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন সুরমা নদীর তীরে আমার ঠিকানারে…….. বাবা শাহ্ জালালের দেশ সিলেট ভূমিরে।

বাংলাদেশের কিংবদন্তী অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেশের দীর্ঘতম সময়ের ও সফলতম সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দান থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরিয়ালা নামক স্থানে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

তাঁর মৃত্যুর খবরে নেমে আসে সর্বস্থারের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া। মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্মরণ কালের শ্রেষ্ট ৩য় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ঢাকায় আজাদ মসজিদ ও সিলেটে নামাজে যানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে নিজ বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দানে মা-বাবা ও তাঁর সহধর্মীনির কবরের পাশে দাফন করা হয়। এম সাইফুর রহমান নামটি এলাকার মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। তিনি ছিলেন উন্নয়নের এক উজ্জল নক্ষত্র। ছিলেন স্পষ্টবাদি উন্নয়নের চাবিকাটি। সাক্ষি হিসেবে জেগে রয়েছে তার অসাধ্য সাধনকারী সকল কর্ম।

সূত্র : পাতাকুঁড়ির দেশ