আসলে বাবারা এমনই হয়!

আসলে বাবারা এমনই হয়!

সাদাত হোসাইন::

আমার বাবা তখন দেখতে ছিলেন অনেকটা হলিউড অভিনেতা রাসেল ক্রো’র মত। চওড়া কাঁধ, বিশাল বুকের ছাতি, ধবধবে ফর্সা মানুষটা যখন স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাঁটতেন তার মাসল দেখে আমার বন্ধুরা বলত, 'আল্লাহ, কত্ত মোটা!'

আমরা তখন সিক্স-সেভেনে পড়া টিনটিনে বালক। মাঠে গিয়ে একদিন আমার এক বন্ধু তার লুঙ্গি উরু অবধি তুলে বললো, 'দ্যাখ, দ্যাখ, আমগো রান আর তোর আব্বার হাতের ড্যানা সমান!' পিতৃগর্বে আমার ছোট্ট বুকের ছাতিও তখন ফুলে উঠত!

১. আব্বা তখন ঢাকায় থাকেন।

ছোটখাট একটা চাকুরী করেন। সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্রবার। তিনি প্রতিমাসে একবার বিষ্যুদবার সন্ধ্যায় সদরঘাট এসে লঞ্চে ওঠেন। সারারাত লঞ্চযাত্রায় শুক্রবার কাকভোরে বাড়িতে। পরের দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে বিকেলের লঞ্চে ফের ঢাকায়।

সেবার আব্বা ভোরবেলা ঘরের দরজায় এসে ভোরের আবছা অন্ধকারে মা-কে ডাকলেন।
মা দরজা খুললেন, আব্বা তার হাতের ব্যাগ দরজায় রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবু এখনো ঘুম থেকে ওঠে নাই?’

মা বললেন, ‘ও-তো বাড়ি নাই, ওর নানুবাড়ি গেছে’। আব্বা কোন কথা বললেন না, তিনি গম্ভীর মুখে বাড়ি থেকে বেরুলেন। আম্মা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন, ঘটনা কী!

আমাদের গ্রামে তখনও যানবাহন বলতে কিচ্ছু নাই। নানু বাড়ি মাইল ছয়েকের পায়ে হাঁটা দূরত্বে। বাবা সেই কুয়াশা ভোরে ছ' মাইল পথ পায়ে হেঁটে নানু বাড়ি পৌঁছালেন।

আমি তখনো গো গো করে ঘুমাচ্ছি। ঘুমের ভেতরই আমাকে বিছানা থেকে টেনে কাঁধে তুলে নিলেন আব্বা। তারপর আবার ছ মাইল পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন।

আমি ঘুম থেকে জেগে দেখি, শুয়ে আছি বাড়িতে। অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমার পাশে শুয়ে আছেন আব্বা! বার দুয়েক এদিক সেদিক তাকিয়ে আমি চোখ কচলালাম, স্বপ্ন নয়তো!!

২. সেবার প্রচণ্ড গরম পড়েছে।

আব্বার সাথে ঝগড়া করে নানু বাড়ি চলে গেছেন আম্মা। আব্বা অবশ্য এই নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য কিছু করেন নি। সারাদিন নানান কাজ-টাজ সেরে সন্ধ্যার আগে আগে আমাকে বললেন, ‘চল ব্যাটা, তোর মা’রে গিয়া নিয়া আসি’।

আমি তখন ছ’-সাত বছরের দুষ্টু বালক। আব্বা আগে আগে হাঁটছিলেন, আমি পিছে পিছে। বাড়ি থেকে কিছু দূর যেতেই রাস্তায় পড়ে থাকা টুকরো কাঠে চোখ আটকে গেলো আমার। কাঠের বুক ভেদ করে জং ধরা পেরেকের অর্ধেকটা বের হয়ে আছে। আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপে গেলো। অনেক চেষ্টা করলাম পা দিয়ে পেরেকটার মাথা বাঁকা করার। পারলাম না। শেষ অবধি রেগেমেগে পায়ের গোড়ালি দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম পেরেকের মাথায়। ঘ্যাঁচ শব্দে সেই অর্ধেকটা পেরেকের প্রায় পুরোটাই আমার স্পঞ্জের স্যান্ডেল ভেদ করে ঢুকে গেল পায়ে।

আমি আকাশ কাঁপানো চিৎকারে পা চেপে ধরে বসে পড়লাম। আব্বা দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। নানু বাড়ির বদলে আমাকে কোলে করে আবার ফিরে এলেন বাড়িতে। আশেপাশে কোন ডাক্তার নেই। দাদী নানা গ্রাম্য চিকিৎসা শুরু করলেন।

রাত গভীর হলো। আমি কান্না শুরু করলাম, 'আম্মার কাছে যাবো'। কিন্তু অত রাতে সেটা সম্ভব না।

আব্বা আমাকে কোলে তুলে উঠান ঘিরে হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি যখন হাঁটেন, তখন তার হাঁটার ছন্দে আমি পায়ের ব্যথা খানিক কম টের পাই। কিন্তু তিনি হাঁটা থামালেই ব্যাথাটা বেড়ে যায়। আব্বা থামলেই আমি তাই গুঙিয়ে কেঁদে উঠি। হাঁটা শুরু করলেই আবার চুপ হয়ে যাই। তখন খানিক আরাম লাগে।

সেই রাতে ফজরের আজান অবধি সারাটা রাত আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটলেন আব্বা। হাঁটলেন ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায়...

৪. আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ি।

জলবসন্ত উঠেছে। শরীর জুড়ে বড় বড় টসটসে বসন্ত। অসহ্য ব্যাথা, অস্বস্তিকর অনুভূতি। সম্ভবত কোন এক ঈদের আগের দিন। আব্বা ঢাকা থেকে এলেন দুপুর বেলা। আমি শুয়ে আছি উঠানে ডালিম গাছের নিচে। আব্বা বাড়ি ঢুকেই দেখলেন আমাকে। আমার গাভর্তি জলবসন্ত। আমি করুণ গলায় গোঙাচ্ছি। আব্বাকে দেখে আমার গোঙ্গানি যেন খানিক বেড়ে গেল। তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর খুব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এতো অল্পতে ব্যাটা মাইনষের কিছু হয়? হয় না। এইটুকুতে এইরকম কাতর হইলে চলে না, ব্যাটা মাইনষের কাছে এইটা কোন অসুখ হইলো?'

আব্বা আর আমার পাশে দাঁড়ালেন না। আম্মাকে, ডেকে চিৎকার করে বললেন, ‘কই, ভাত দাও, খিদা পাইছে’। আমার চোখ ফেটে কান্না চলে এলো, আব্বা এমন করলেন!

মেঝেতে পাটি পেতে ভাত খেতে বসেছি আমি, ছোট ভাই, আব্বা আর আম্মা। আব্বার দুধ-কলা-ভাত খুব পছন্দ। আমি আড়চোখে আব্বার দিকে তাকালাম। আব্বার প্লেটভর্তি দুধ। কিন্তু তিনি প্লেটে হাত দিচ্ছেন না। বসে আছেন। হঠাৎ দেখি প্লেটভর্তি দুধের ভেতর টুপটাপ টুপটাপ কিছু একটা ঝরে পড়ছে।

কী পড়ছে?
আমি আব্বার দিকে ভালো করে তাকালাম।
তিনি নিঃশব্দে কাঁদছেন।

৫.
২০০৬ সালে আব্বা স্ট্রোক করে অনেকটাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আব্বা তার ডান পাশটা নড়াতে পারেন না। রাসেল ক্রোর মতন দেখতে সেই মানুষটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেলেন। হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেলেন। সারাদিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। চুপচাপ। নিঃশব্দ। কারো কাছে কোন চাওয়া নেই, অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। বাইরে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। আদিগন্ত নীল আকাশ। তিনি নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। আমার খুব ইচ্ছে হয়, মানুষটাকে কাঁধে নিয়ে ছুটি। আমাকে নিয়ে যেমন ছুটেছেন মাইলের পর মাইল। ঠিক তেমনি।

উড়ে যাই আদিগন্ত দিগন্তে।

৬.
পুকুর থেকে উঠান পেরিয়ে ঘরে ফিরছিলাম, দরজায় তাকিয়ে দেখি আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। শান্ত শিশুর মতো। তিনি ডান হাত খুব একটা তুলতে পারেন না। ফলে নিজের হাতে খেতে পারেন না। মাথা আঁচড়াতে পারেন না। আমার ছোটবোন তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে কী অদ্ভুত মমতায় আব্বার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। যেন কোনো মা প্রগাঢ় মমতায়, স্নেহে, ভালোবাসায় তার সন্তানের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। আর আব্বা শান্ত ছোট্ট শিশুটির মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। যেন খানিক নড়লেই মায়ের বকা খাবেন। সেই বকার ভয়ে প্রায় সত্তর বছরেও সুবোধ বালক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমি হতভম্ব হয়ে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিংবা সেই দৃশ্য আমার দিকে। আমার হাতে ক্যামেরা। সেই ক্যামেরা আমার অজান্তেই যেন ছবিগুলো তুলে ফেললো। আমি সেই ছবিগুলো যত্ন করে সঞ্চয় করে রাখলাম।

কোনো একদিন, যখন বুড়ো হয়ে যাবো, তখন এই ছবিটা আমি আমার মেয়েকে দেখাবো। দেখিয়ে বলবো, 'মারে, তুই কি জানিস, এই ছবিটার কোথাও না কোথাও আমিও থাকতে চাই। থাকতে চায় পৃথিবীর সকল বাবাই!'

তখন কী বলবে আমার মেয়ে?

পৃথিবীর সকল বাবা ভালো থাকুক। পৃথিবীর সকল সন্তান তাদের আগলে রাখুক। আগলে রাখুক প্রগাঢ় মমতায়, প্রগাঢ় ভালোবাসায়।

জুড়ীর সময়/ডেস্ক