লংলার বন এখন কালাপাহাড়

লংলার বন এখন কালাপাহাড় - কুলাউড়া - জুড়ীরসময়


খোর্শেদ আলম::

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ঐ দূরে যে পাহাড় সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সবুজ গালিচায় পাহাড় সৌন্দর্য ছড়িয়েছে বহু দূর পর্যন্ত।  এটি সাগরনালের অংশ। পেছনে দক্ষিন ও পশ্চিম অংশটি লংলার পাহাড় এটি প্রাচীন নাম। এই বনটিকে একত্রে বলা হয় হারারগজ রিজার্ভ ফরেস্ট।

অবস্থিত সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে। এটি সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ চূড়া উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১১০০ ফুট।

নানান প্রজাতির বৃক্ষঘেরা মিশ্র চির সবুজ ঘন বাঁশবন আর লতাগুল্ম দিয়ে যেন সাজানো এক প্রকৃতির অলংকার। নাম "কালাপাহাড়"। এই নাম শুনে বিস্মিত হওয়ার কথা! তবে, নাম শুনে অনেক মনে কৌতুহল জাঁগে বনটি ঘুরে দেখার। যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি দূর্গম! দীর্ঘ ৩ ঘন্টা খাড়া পাহাড়ী পথ বেয়ে যখন সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাবেন নিমিশেই দূর হবে পেছনের সকল ক্লান্তি।

এডভেঞ্চার প্রেমিরা সব সময় বেচে নেয় ঝর্ণা কিংবা পাহাড়ের চূড়া। ঠিক, এমনই একটা স্থান লংলার পাহাড় যাকে এখন কালাপাহাড় বলা হয়। একবার সেই চূড়ার প্রেমে পড়লে বার বার পিছুটানবে এমন দৃষ্টান্তে। কালাপাহাড় বা লংলার পাহাড় নামের সাথে পরিচিত হলেও, ট্রেকিং এ গিয়ে আরেকটি নতুন নাম জানলাম গাইডের থেকে। "আলীর পাহাড়"।

এই বনের  অনেক পূরণো গল্প আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। বই পুস্তকের মাধ্যমে বনটি সম্পর্কে পূরনো অনেক গল্পের কথা জেনেছি। তবে, বাস্তবে কি আছে তা জানার বিষয়।

বনটি দেখে ধারণা করা যায় এখানে অনেক ধরনের বন্যপ্রাণী অস্তিত্ব রয়েছে। আসলে গবেষণা না করে একটি বনের বন্যপ্রাণীর তালিকা করা যাবে এটা ভুল। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের একটি বন এই ধারণার বাস্তব চিন্তা বদলে দিয়েছে। যেখানে ক্যামেরা ট্রাপিং এর মধ্যে দেখা মিলেছে বন ছাগল (সেরু) ব্যাজার ও কালো ভালুকের মতো দূর্লব  প্রাণীর। এটি আসলে এই বনের নতুনত্বের সম্ভবনার উদাহরণ।

অবাক হবেন এই বনের পূর্বের ইতিহাস  শুনলে! কি এমন গল্প? মিশ্র চির সবুজ সমৃদ্ধ এই বনে এক সময় বাঘের বেশ উৎপাত ছিল। বলছি দেশ স্বাধীনের কাছাকাছি সময়ের কথা। ঐ এলাকায় এনায়েত মাওলা নামের একজন শিকারি ছিলেন। তিনি একটি বই লেখেছেন "যখন শিকারি ছিলাম" এই বইয়ে উল্লেখ ছিল সাগরনাল ও রত্না চা বাগানের কথা। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছরের আগের কথা। তখন সাগরনালের অংশে তিনি একটা বাঘ শিকার করেছেন। গল্পটি আর কতো দিন আগের, মাত্র কয়েক বছর পূর্বের ঘটনা। সিলেটের বন থেকে এসব প্রকৃতির প্রাণ হারিয়ে ফেলেছি! অদৌ ফিরবে কি আর?

গভীর বনে এখন লড়াই করে ঠিকে থাকার অস্তিত্ব সম্ভাবনাময়। এটি এখন নিবিড় ভাবে গবেষণা করে দেখার বিষয়। অনেকের'ই জানার কৌতুহল জাঁগে কি আছে আর কি হারিয়েছি।

শুধু বাঘ নয় পথে'ই আমাদের চোখের সামনে দেখা পেয়েছি হলদে গলা মারটেনের। এরকম এই বনে বিরল অনেক ধরনের বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব এখন ঠিকে আছে। এদের ঠিকে থাকার অস্তিত্ব নিশ্চিত করা এখন উপযুক্ত সময়। পেছনে থাকিয়ে আর লাভ নেই! এই বনের প্রাণ গুলো না বাঁচাতে পারলে এক সময় প্রভাব পড়বে মানব সভ্যতার উপর।

২০১৫ সালের কথা। একদল ভ্রমণপ্রিয় এডভেঞ্চার প্রথম এ চূড়া সামিট করে। তারপর থেকে সময়ের ব্যবধানে এই পাহাড়শ্রেণী টেনে এনেছে বহু ভ্রমণপ্রিয় মানুষকে। দূর্গম বন কালাপাহাড়কে আমরা ও বেচে নিয়েছি। সাথে ছিলেন বন্ধুবর খন্দকার নেওয়াজ। আমরা সিদ্ধান্ত নেই খুব ভোরে রওয়ানা দিবো। এর আগের দিন কুলাউড়া'র স্থানীয় একটি হেটেলে উঠলাম। পরের দিন ঠিক সকালে আমরাও প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছি। নাস্তা করে হাল্কা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি'র মধ্যে রেইনকোর্ট পরে রওয়ানা দিয়েছি বেগুন ছড়া পুঞ্জিকে উদ্যেশ্য করে। তার আগে নলডুরি বিট অফিসে পৌঁছাই। তখন সকাল ৮ টা বাজে। সেখানে গিয়ে ফরেস্ট গার্ড শাকিল হোসেনের সাথে দেখা হয় তিনি আমাদের একজন দক্ষ ট্যুর সঙ্গী দিলেন। আমরা রওয়ানা হই বনের দিকে। হালকা বৃষ্টি পাহাড়ী পিচ্ছিল পথ ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে অর্ধেক পথ পার হলাম। তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন সহযোগী খন্দকার নেওয়াজ। তবে, কোন প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি হামাগুড়ি খেয়েও আমরা পৌঁছেছি গন্তব্যে। সেখানে গিয়ে গিয়ে এই ক্লান্তের কথা ভুলেগেছি নিমিষেই। এর মধ্যে রয়েছে এক ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার গল্প।

কালা পাহাড় আসলেই একটি দূর্গম ভয়ংকর বন যেখানে বিচরণ করে পোষা হাতি গুলো। হাতি গুলো যদিও পোষা তবে, জংলি হাতির চেয়ে কম কিসের! সে এক বাস্তব চিত্র চোখের সামনে সাক্ষি হয়ে আছে। ফারুক মিয়া (৩৫) আমাদের সাথে যে ট্যুর গাইড ছিল তিনি দূর্দান্ত সাহসি ব্যাক্তি। বনের প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রেইল ধরে হাটতে শুরু করেছি একটু সামনে গিয়ে পাওয়া গেল হাতির পায়ের তাঁজা চাপ। বুঝতে আর বাকি নেই সামনে হাতি আছে। একটু দূরে যাওয়ার পর বুঝতে বাকি নেই আমরা হাতির মুখামুখি হয়েগেছি! সাথে সাথে'ই হাতির উচ্চ কর্কশ শব্দের আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে পেছনের দিকে পালিয়েছি। এটি আমাদের জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। বনে ছাড়ার সময় পোষা হাতি গুলোর পায়ে শেকল বাধা থাকে, তেমনি ঐ হাতিটার ও ছিলো। যদি পায়ে শেকল না থাকতো তাহলে আমরা ৩ জন'ই বেঁচে ফিরতাম না। দূর্গম কালা পাহাড়ে গেলে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, অন্যতায় বড় কোন বিপদ হতে পারতো।

গহীন এই অরণ্য। নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক কিংবা শশব্যস্ত হরিণের পথ চলা। রয়েছে অন্যতম বৃহৎ বাঁশ-মহাল এ অরণ্যে। এখনো লোকচক্ষুর অনেকটা আড়ালে বলে রাস্তাগুলোও যেনো এখন অফ ট্রেইল। একপাশে হাকালুকি হাওড়ের জলের তৈ তৈ দেখা পাওয়া কিংবা মেঘের আড়াল থেকে সরে ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে জ্বলজ্বল করে ওঠা ভারতের ত্রিপুরা শহরের আলো যেনো সমস্ত ট্রেকিং এর কষ্ট নিমিশে ভুলিয়ে দেবে।

এই পাহাড়শ্রেণী ঘুরে দেখতে চাইলে শরৎ কিংবা শীতকালে আসতে পারেন। পাহাড়ি ছড়ায় স্বচ্ছ মৃদুমন্দ বয়ে চলা জলের ধারা আর তূলনামূলক কম পিচ্ছিল টিলায় টিলায় চলার রাস্তা বেশ সুবিধে দেবে। সেই সাথে শীত ও শরৎের পরিষ্কার আকাশের কারণে অনেক দূর পর্যন্ত ভিউ পাবেন!  সবার ভালো লাগবে নিশ্চিত।

পাহাড়ী উঁচু ট্রেইল ধরে হাটতে হবে অবশ্যাই খাওয়ার পানি স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সাথে নেওয়া বাধ্যতামূলক। সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। পাহাড়ে ঘুরতে আসতে চাইলে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসন বন বিভাগ অথবা থানায় জানিয়ে রাখবেন। যেনো যেকোনো বিপদে ও প্রয়োজনে সহায়তা পেতে পারেন। আর ভ্রমণ করুন 'লিভ নো ট্রেস' পদ্ধতি মেনে।  সচেতন থাকুন পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে।

যেভাবে যাবেন:
দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে সরাসরি কুলাউড়ায় আসবেন। কুলাউড়া থেকে রবিরবাজারে যাবেন। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা দিয়ে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের কাছে নলডুরি বন বিট অফিসে যাবেন। বিট অফিসের কাছে গিয়ে স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড নিয়ে সহজে যেতে পারবেন।

জুড়ীরসময়/কেআ/সাইফ