হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু সম্পর্কে ইসলামের বিধান

হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু সম্পর্কে ইসলামের বিধান

মোঃ মেহেদী হাসান::

পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে অনেকেই অনেক হারানো জিনিস পেয়ে থাকেন। কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটি কি করতে হবে তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দে ভোগেন। তাই ইসলামে হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু বিষয়ে কি নির্দেশনা দিয়েছে তা জেনে নেওয়া প্রত্যেকের জন্যই একান্ত জরুরী।


ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ‘হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু’ বলতে বোঝায়, এমন সম্পত্তি বা বস্তু যা তার মালিকের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে, আর অন্য কেউ তা কুড়িয়ে পেয়েছে। অথবা এমন কোনো বস্তু যা কোনো ব্যক্তি পড়ে থাকতে দেখে তা কুড়িয়ে নিয়েছে এবং আমানত হিসেবে নিজে গ্রহণ করেছে।


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু সম্পর্কে বলেছেন, “তোমাদের কেউ যদি কোনো কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু তুলে নেয়, তবে সে যেন এ বিষয়ে দু’জন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী রাখে। তারপর সে যেন তা গোপন না করে এবং ঐ বস্তুর মধ্যে কোনো পরিবর্তনও না করে। এরপর যদি ঐ বস্তুর মালিকের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে সেই সেটার অধিকারী। আর যদি মালিককে না পাওয়া যায়, তবে ঐ বস্তুটি আল্লাহর সম্পদ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন।” (ইবনে হিব্বান)


হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর প্রকারভেদঃ


কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু মৌলিকভাবে চার ধরনের। যেমন-


১. মালিকানাবিহীন অবস্থায় প্রাপ্ত কোনো বস্তু। যেমন- টাকা, স্বর্ণ, রৌপ্য বা পণ্যসামগ্রী।


২. হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া মানবসন্তান। যাকে কেউ লালন-পলানের ভয়ে কিংবা সন্দেহযুক্ত সন্তান হওয়ায় অপমানের ভয়ে কোথাও ফেলে গেছে। এরকম মানবসন্তানকে যে পাবে, তার দায়িত্ব হবে তাকে লালন-পালন করা।


৩. হারানো চতুষ্পদ জন্তু। যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি।


৪. হারানো খাদ্যজাতীয় বস্তু। যা রাস্তায় বা কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া যায়।


হারানো বস্তু পেলে উদ্ধারকারীর দায়িত্ব


যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির হারিয়ে যাওয়া মালামাল কুড়িয়ে পায় এবং মালিককে ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের আমানতে গচ্ছিত রাখে তবে উদ্ধারকারী ব্যক্তির উপর নিম্নোক্ত দায়িত্বগুলো অর্পিত হবে-


১. উদ্ধারকারী ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে, প্রকৃত মালিকের কাছে হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু পৌঁছে দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত সময় পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকা।


২. প্রাপ্ত দ্রব্য সম্পর্কে যথোপযুক্ত যত্নগ্রহণ করাও উদ্ধারকারী ব্যক্তির কর্তব্য। অবশ্য যুক্তিসঙ্গত উপায়ে যত্ন নেওয়ার পরও যদি দ্রব্যের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তবে এর জন্য উদ্ধারকারীকে দায়ী করা যাবে না।


৩. প্রাপ্ত বস্তু উদ্ধারকারী ব্যক্তির নিকট আমানত হিসেবে থাকবে এ শর্তে যে, উদ্ধারকারী তা হেফাজত করবে এবং মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই তা উঠিয়ে নিচ্ছে।


৪. যদি হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটির মূল্য অল্প হয়, তাহলে উদ্ধারকারী কিছুদিন মালিকের সন্ধানে ঘোষণা দেবে। পক্ষান্তরে বস্তুটির মূল্য বেশি হলে এক বছর ঘোষণা যাবত দেবে। আর মালিককে খুঁজে পাওয়া না গেলে সেই বস্তুটি মালিকের নামে সদকা করে দেবে।


৫. উদ্ধারকারী ব্যক্তির কখনই উচিত নয় যে, প্রাপ্ত বস্তুটি নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা। তবে সে যদি একান্তই নিরুপায় হয় তাহলে শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় তা ব্যবহার করতে পারবে।


৬. উদ্ধারকারী ব্যক্তির জন্য নিজের মালিকানায় থাকা অনুরূপ বস্তুর সঙ্গে কখনই হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটির মিশ্রণ ঘটানো উচিত নয়।


৭. উদ্ধারকারী ব্যক্তি যদি আদালতের নির্দেশ ছাড়া বস্তুটির রক্ষণাবেক্ষণে নিজের অর্থ ব্যয় করে তবে সে স্বেচ্ছাদানকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।


৮. প্রকৃত মালিকের সন্ধান পাওয়ার পর যুক্তিসঙ্গত পারিশ্রমিক এর সাপেক্ষে ঐ বস্তুটি প্রত্যর্পণ করা উদ্ধারকারী ব্যক্তির দায়িত্ব।


৯. কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটির দ্বারা যদি উদ্ধারকারী কোনো বৃদ্ধি বা লাভ পায় তবে তাও প্রকৃত মালিককে প্রদান করে দিতে হবে।


১০. কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু বিক্রি করার পর মালিকের সন্ধান পেলে নিজ পাওনা বাদে অবশিষ্ট অর্থ প্রকৃত মালিককে দিয়ে দিতে হবে।


হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর আরও কিছু বিধান


যদি হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটির মূল্য দশ দিরহামের কম হয়, তবে উদ্ধারকারী কয়েকদিন যাবত ঘোষণা দেবে (এখানে কয়েক দিনের অর্থ আদালত যে কয়দিন সমীচীন মনে করে) অথবা উদ্ধারকারী ব্যক্তি তার বিবেক অনুসারে যে কয়দিন যথেষ্ট মনে করে।


পক্ষান্তরে, যদি হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুটির মূল্য দশ দিরহামের বেশি হয়, তবে এক বছর যাবত ঘোষণা দিতে হবে। তবে এই ঘোষণা এমন স্থানে হতে হবে, যেখানে ঘোষণা দিলে তা মালিকের কাছে পৌঁছবে বলে সমূহ ধারণা করা যায়। বিশেষ করে যেখানে বস্তুটি কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে ঘোষণা দেওয়াই অধিক উত্তম। কারণ সাধারণত সম্পদ হারানোর পর সম্পদের মালিক সেই পথেই খুঁজতে থাকে, যেখানে সে তা হারিয়েছিল।


এছাড়া মানুষের সম্মিলনস্থলে যেমন- বাজার, মসজিদের দরজা; যখন মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হন এসকল সময়ে ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে। তবে মসজিদের ভেতরে হারানো জিনিসের ঘোষণা করা বৈধ নয়। কেননা মসজিদ ইবাদতের জন্য তৈরি হয়েছে; হারিয়ে যাওয়া বস্তুর ঘোষণার জন্য নয়। আর যদি মরুভূমি বা বিস্তীর্ণ মাঠে কোনো বস্তু কুড়িয়ে পাওয়া যায়, তবে নিকটস্থ কোনো লোকালয়ে তার ঘোষণা করতে হবে।


যদি হারানো বা কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু এমন প্রকৃতির হয় যে, মালিক তার সন্ধান করবে না, তবে তা ফেলে রেখে যাওয়াই উচিত। আবার ঘোষণা করা ছাড়া নিজেও তা দ্বারা উপকৃত হওয়া বৈধ।


লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

জুড়ীরসময়/ডেস্ক/এবিডি