জুড়ীতে স্বাধীনতার ৫১ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার



খোর্শেদ আলম:

একাত্তর সালের জুলাই মাসের মধ্যভাগ। মুক্তিবাহিনী তখন চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে সরে পড়ার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। এভাবে অতর্কিত আক্রমণে হানাদার বাহিনীকে ব্যাতি ব্যস্ত করে রাখাটাই উদ্দেশ্য। এসময় ৪নং সেক্টর সদর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, কোন একটি এলাকা দখলে নেওয়ার। এজন্য একটি গ্রুপ গঠিত হয়। ২০ জুলাই প্রকাশ্যে দিবালোকেই দিলখুশ চা বাগান আক্রমণ করে বসে তারা। অধিনায়ক হক ও একজন গাইড একটি উঁচু গাছে চড়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই গাইড ছিলেন আকবর আলী। উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে যায় তুমুল গোলাবর্ষণ। একপর্যায়ে হানাদারদের পদলেহী এক মহিলা পাক বাহিনীকে ক্যাপ্টেন হকের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করলে, পাথারিয়া টিলা থেকে পাক-সেনারা ঐ গাছ লক্ষ্য করে ১৫৫ ইঞ্চি মর্টার ছোঁড়ে। গাছ থেকে পড়ে যান ক্যাপ্টেন হক ও গাইড আকবর আলী। সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সেই পথ প্রদর্শক আকবর আলী। এখানেই জীবনের ইতি ঘটে তার। ক্যাপ্টেন হকের ডান পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলে তখন চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠানো হয়। যুদ্ধের পরে ক্যাপ্টেন হক কে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাপানে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।

শহীদ আকবর আলীর বাড়ী মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার লাঠিটিলা গ্রামে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪ নং সেক্টরে কাজ করেন। তিনি যুদ্ধকালিন সময়ে একাত্তর সালের ২০ জুলাই শাহাদাত বরণ করেন। তখন তার একমাত্র ছেলে ময়না মিয়ার বয়স মাত্র ৬ বছর। বাবার মৃত্যুর পর একদম হতভম্ভ হয়ে পড়েন ময়না মিয়া। কোন উপায় ছিল না মাথা তুলে দাঁড়ানোর। তখনি শুরু  হয়েছে পরিবারের দায়িত্বের ভার বহন করা। ছয় বছর বয়সে যখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা তখনি শুরু বাস্তব জীবনের সাথে যুদ্ধ করা। এখনও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে ময়না মিয়ার পরিবারকে! 

সরজমিনে শহীদ আকবর আলীর বাড়িতে গেলে দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি ঘর। ঘরটিতে ৫ সদস্যের বসবাস। কোন মতে মাথা গোঁজার ঠাই নিয়ে বসবাস করছে পরিবারটি। বাড়ির পাশে কবরস্থানে শায়িত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কবরটি অরক্ষিত অবস্তায় ফেলে রাখা! নেই রাষ্ট্রীয় সম্মান, পরিবারের দাবি একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। নূন্যতম শহীদের কবরটি যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায় এটাই তাদের চাওয়া।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ময়না মিয়া জানালেন জীবনের কঠিন সময়ের কথা। তিনি বলেন, বাবার মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধকালীন সময়ে। তখন আমি খুব ছোট্ট, বয়স অনুমানিক ৬ বছর। তখন থেকে আমার ঘাড়ে পরিবারের বোঝা। এই ছোট্ট বয়সে আমার জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। যখন স্কুলে যাওয়ার কথা তখন মাঠে কাজ করেছি। পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে অনেক মানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। যা আমার বাকি জীবন যদি গল্প করে যাই তবুও শেষ হবে না। আমার বাবা দেশের জন্য তাজা প্রাণ দিয়েছেন, বুকের তাজা রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু, বিনিময়ে আমি এবং আমার পরিবার সরকার থেকে কোন ধরনের সুযোগ পাচ্ছি না। একজন শহীদের সন্তান হয়েও আজ আমি অসহায়! কে শুনবে আমার কান্না?

তিনি বলেন, বর্তমানে আমি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আমি কোন ভাবে টিকে আছি। এখন আমার অসহায় পরিবার নিয়ে চিন্তিত। কোন রকম খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি।  

ময়না মিয়া বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও মৌলভীবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকে ক্রেস্ট সম্মাননা পেয়েছি। ক্রেস্ট বা সম্মাননা দিয়ে তো আর পেট ভরবে না। সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভাতা দেয় সে ভাতা পেলে অন্তত কিছুটা হলেও আমাদের কষ্ট লাঘব হত। এবং আমার বাবা স্বাধীনতার ৫১ বছর পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতেন। 

আকবর আলী সম্পর্কে লাঠিটিলা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা বাবুল মিয়া বলেন, আকবর যুদ্ধের সময় শহীদ হন। যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আমি তখন ৪নং সেক্টরে ছিলাম। সেখানে আকবর আলী মেজর শরীফুল হক ডালিম সহ সঙ্গীয় ফোর্সের সাথে ছিল। তিনি যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য একটি বড় গাছে উঠেন। গাছে যুদ্ধের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য। ঠিক তখনি পাকবাহিনী গাছটিকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলে তখন ঘটনাস্থলে নিহত হন তিনি। শহীদ আকবর আলী সম্পর্কে আমি নয় শুধু উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মোঈদ ফারুক সহ জুড়ীর সকল মুক্তিযোদ্ধার জানা আছে।

জুড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার কুলেশ চন্দ্র চন্দ মন্টু বলেন, জুড়ী উপজেলায় ৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাননি। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তাদের স্বীকৃতির জন্য। এক্ষেত্রে যারা জনপ্রতিনিধি আছেন তাদেরও ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় স্বীকৃতি দিতে হবে। তবে আমি যতদিন আছি তাদের স্বীকৃতির জন্য কাজ করে যাব।

তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ মুমিত আসুক জায়ফরনগর ইউনিয়নের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল নুর এর নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সাগরনাল ইউনিয়নের আব্দুর রহিম চৌধুরীর নামে আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেন। এছাড়া গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের শহীদ আকবর আলীর নামে আর কিছু হয়নি। শুনেছি আকবর আলীর কবরটিও অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে। 

জুড়ী উপজেলা নির্বাহি অফিসার সোনিয়া সুলতানা জুড়ীরসময়কে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। এটি কোন পর্যায়ে আছে আমি তার পরিবার বা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যিনি ছিলেন তাদের কাছ থেকে কখনও শুনিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে আমার পক্ষ থেকে যতটুকু করার তা আমি করব। 

জুড়ীরসময়/ডেস্ক/খোর্শেদ/এএ