প্রাকৃতিক স্বর্গ জুড়ী, কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে অবহেলিত

প্রাকৃতিক স্বর্গ জুড়ী, কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে অবহেলিত


খোর্শেদ আলম:: 

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সৌন্দর্য-বিলাসী জেলা মৌলভীবাজার।এই জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে জুড়ী উপজেলা পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এখনো অপেক্ষা করছে উন্নয়নের আলো দেখার। প্রাকৃতিক ও নৃ-সংস্কৃতির অপার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হলেও নানা সংকটে পিছিয়ে পড়ছে জুড়ীর পর্যটন শিল্প। প্রকৃতিবান্ধব জুড়ী যেন এক বিস্ময়কর ভূ-স্বর্গ।

জুড়ীতে রয়েছে বিস্তৃত হাওরাঞ্চল, পাহাড়, বন, ঝর্ণা, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও আদিবাসী সংস্কৃতি। হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশি, পরিযায়ী পাখিদের কোলাহল, নৌকা ভ্রমণের রোমাঞ্চ সব কিছুই যেন এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার আমন্ত্রণ জানায়।

পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টেের জুড়ী অংশে রয়েছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ঝর্ণা। সীতাকুণ্ড, মায়াবন, মায়াকানন, সন্ধানী, শুভাকাঙ্ক্ষী, বিষকরম ইত্যাদি। তাছাড়া রয়েছে, হাতি নালা গিরিখাত, লাঠিটিলার ব্রিটিশ আয়রণ ব্রিজ, ধসল পাহাড়ের শিবমন্দির, কাশ্মির টিলা, লালছড়ার কমলা বাগান ও সাগরনালের হাড়ারগজ সংরক্ষিত বন এবং কালাপাহাড় (সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ চূড়া) সবই জুড়ীকে পর্যটন মানচিত্রে স্থান দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 

খাসিয়া সম্প্রদায়ের জীবনযাপন, মনিপুরি তাঁতশিল্প ও তাঁদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য আরও শিল্পকর্ম এক ভিন্নমাত্রার অভিজ্ঞতা দেয় পর্যটকদের। এইসব কিছুই জুড়ীকে করে তোলে একটি ‘হিডেন ট্রেজার’।

অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জুড়ীর পর্যটন এখনও মূলধারায় আসেনি। এর পেছনে রয়েছে অবকাঠামোগত নানা ঘাটতি—মানসম্মত আবাসন, নিরাপদ খাবার হোটেল, ভালো রাস্তা, সাইনবোর্ড, গাইড ও তথ্যকেন্দ্রের অভাব। বর্ষায় অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রচার-প্রচারণার অভাবে অধিকাংশ পর্যটক জুড়ী সম্পর্কে জানেন না।

মৌলভীবাজারের আধুনিক ট্যুরিজম'র প্রতিষ্ঠাতা ব্যবসায়ী আশরাফ আলী বলেন, সরকারি স্বীকৃতি ও পর্যটন ঘোষণার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে গাইড প্রস্তুত, প্রচারণা জোরদার, রোড ম্যাপ তৈরি, ইকো ট্যুরিজম মেনে চলা, নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, হাওরে বর্ষা মৌসুমে খেয়াঘাট নির্মাণ, পর্যটন স্পটে তথ্য বোর্ড বসানো, স্থানীয়দের পর্যটনবান্ধব আচরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি নিরাপত্তা জোরদার করা। এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

ইমরান ট্রাভেলস এর স্বত্তাধীকারি ইমরানুল ইসলাম বলেন, জুড়ীর সৌন্দর্য শুধুই প্রাকৃতিক নয়, এখানে লুকিয়ে আছে সংস্কৃতি, ইতিহাস, জীবনবোধ আর বৈচিত্র্যের অপূর্ব মিশ্রণ। সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি স্বীকৃতি ও স্থানীয় অংশগ্রহণ থাকলে জুড়ী বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে। এখন প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দৃঢ়তা। সময় এসেছে, জুড়ীকে পিছিয়ে না রেখে সামনে এগিয়ে দেওয়ার।

জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খান বলেন, বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক ও পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য এক গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি জমি, জলাশয়, এবং বাস্তুতন্ত্র এই ক্ষতিকর উপাদানের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে চাষাবাদের জমিতে পলিথিন জমে থেকে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং পানি নিষ্কাশনের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

এ বিষয়ে জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাবুল সূত্রধর বলেন, জুড়ী উপজেলার পর্যটন শিল্প নিয়ে খুব বড় পরিসরে কিছু করার সুযোগ সীমিত। এখানে উল্লেখযোগ্য পর্যটন অবকাঠামো বা সুপরিচিত স্থান নেই। পাথারিয়া বনের কয়েকটি ঝর্ণা সম্পর্কে জানা গেছে, তবে সেটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়ায় সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশে বিধিনিষেধ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাকালুকি হাওর একটি বিশাল জলাভূমি, যা শুধুমাত্র জুড়ী উপজেলাকে ঘিরে নয়, পাঁচটি উপজেলার অংশজুড়ে বিস্তৃত। ফলে এককভাবে জুড়ী থেকে এর পূর্ণ ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে, হাওরের পর্যটন সম্ভাবনাকে সামনে রেখে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।

জুড়ীরসময়/কেআ/সাইফ