প্রবাস থেকে জুলাই বিপ্লব ও জুড়ী

প্রবাস থেকে জুলাই বিপ্লব ও জুড়ী


রায়হান আহমেদ:: 

কোটা সংস্কারের আন্দোলনটা তীব্রতা লাভ করে ১৬ জুলাইতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী তরুন আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে। ঠিক পরদিন থেকে বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যেন আবু সাঈদকে ভাই হিসেবে ওউন করে, ভাইয়ের মৃত্যুর বিচার ও পূর্ণাঙ্গ জাস্টিস আদায়ে মাঠে নেমে পড়ে। মূলত আন্দোলন ঐদিনই কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে রূপ লাভ করে।

১৭ জুলাই সন্ধ্যায় জুড়ী উপজেলার তামিম জামান আমাকে মেসেজ করে, বললো ভাই কিছু করেন; কি ই বা করতে পারি আমরা বিদেশ থেকে? মোটিভেশন, আর্থিক সাপোর্ট, সোশাল মিডিয়ায় হাইপ তুলা ছাড়া। এগুলো তো করেই যাচ্ছিলাম আমরা, যা দারুন ভূমিকা রেখেছে জুলাই আন্দোলন সফল করতে। ঐদিনই তামিমের কাছ থেকে আন্দোলনের কিছু ছবি ও ভিডিও ডকুমেন্টস নিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে এইখানকার লোকাল এমপিকে ইমেইল করি। 

ইউকে তে অবস্থানরত সাবেক শিবির আগেরদিন রাতেই (১৬ তারিখ) সিধান্ত নেয় যার যার লোকাল এমপিকে ইমেইল করবে যতসম্ভব আন্দোলনের তথ্য উপাত্ত সংযুক্ত করে দিয়ে। যেন এটা বৃটিশ পার্লামেন্ট এ আলোচ্য হয়। আমি এটার রেসপন্স পেয়েছিলাম ৩১ তারিখে এমপির অফিস থেকে।

১৮ জুলাই রাত থেকে বাংলাদেশে সকল ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় একদম রোরাল এরিয়ার খবর গুলো পাচ্ছিলাম না। বড় বড় শহরের খবর আসতেছিলো জাতীয় টেলিভিশন ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের মারফতে। এর মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে সোশাল মিডিয়ায় কিছু অথেনটিক খবর ও পাচ্ছিলাম; দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। আন্দোলন তখন পর্যন্ত গ্রাম ও গ্রামীনবাজার গুলোতে ছড়ায় নাই। ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের যখন জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো, আন্দোলন এরপর থেকেই ছড়িয়ে যায় লোকান্তরে।

১০ দিন পর ২৮ জুলাই ইন্টারনেট সেবা চালু হবার পর খবর নিতে থাকি নিজ এলাকা জুড়ীর৷ তীব্র ক্রোধ আর ক্ষোভ নিয়ে ফুসতে থাকে দেশপ্রেমিক ফ্যাসিস্ট বিরোধী আমার ভাইয়েরা। খুব সম্ভবত ততদিনে জুড়ীতে বৈষম্য বিরোধী ব্যানারে কিছু শিক্ষার্থী এক হতে থাকে। আমার তাদের সাথে তখনো যোগাযোগ হয় নি। আমার বন্ধু নাঈম আহমেদ এর সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে রাতভর আলোচনা হতো, বিশ্লেষণ হতো কি হচ্ছে আর সামনে কি হতে যাচ্ছে এইটা নিয়ে। জুড়ীর অনেকেরই (যে কয়জনের সাথে কথা হতো) মাঝে তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখতে পেলাম জাতীয় কর্মসূচির সাথে একাত্মতা পোষন করে মাঠে নামার। ছোট ছোট আকারে সংঘবদ্ধ ও ছিলো ওরা। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি সংঘটিত ছিলো সম্ভবত ওসমান গনি ও এর সতীর্থরা।

১৬ জুলাই জুড়ীতে প্রথম প্রকাশ্যে মাঠে নামে উসমান ও আমির হামজা দের সংঘটিত প্লাটফর্মটি। ১ আগস্ট খবর পেলাম মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া উসমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। জুড়ী থেকে আন্দোলনের কারনে শিক্ষার্থী গ্রেফতার হবে বিষয়টা আমাকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। চিন্তা করলাম, এর প্রতিবাদ করতে হবে এবং অনেক বড় পরিসরে মাঠে নামতে হবে তাহলে ছাত্রলীগ হামলার সুযোগ পাবে না এবং জুড়ীকে ভালভাবে নাড়া দেওয়া যাবে। এতে আন্দোলনে সাধারণ মানুষদের সমর্থন বাড়বে।

একদিকে নাঈম আহমেদ (এসএসসি-১৭) এর সাথে আন্দোলনের ব্যাপারে কন্টিনিয়াস আলোচনা চলছিলো, তাকে শেয়ার করলাম জুড়ীতে কীভাবে সবাইকে সংঘটিত করা যায়। যে কয়টা গ্রুপ আছে কিভাবে একত্রিত করা যায়, নতুনদের কিভাবে যুক্ত করা যায় এ নিয়ে। যদিও সকলের ভেতরে আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ ইতোমধ্যে বিরাজ করছিলো। 

একটা ভয়ের কথা নাঈম বলছিলো, মামলার হয়রানি নিয়ে যেজন্য সবাই আসতে চাইবে না। এ ব্যাপারে তাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিলাম।

২ আগস্ট, আমরা আলোচনা করি পরদিনের অসহযোগ আন্দোলনে কিভাবে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় এ নিয়ে। তার সাথে হিসেব করলাম জুড়ীতে ছাত্রলীগের সংখ্যা সব মিলিয়ে পঞ্চাশ (৫০) ও হবে না। এদিক থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যদি ২-৩শ মানুষ রাস্তায় থাকলে ওরা কাছেও ঘেষতে পারবে না। আর এটা ম্যানেজ করা খুব একটা কষ্টসাধ্য নয়, শুধু যোগাযোগ আর সমন্বয় এর ঘাটতি দেখছিলাম সবার মাজে। আমরা আলোচনা করেছিলাম সবার সাথে এসএসসি ব্যাচ ভিত্তিক নাকি এলাকা ভিত্তিক যোগাযোগ করব? নাঈম, মত দিয়েছিলো দুটোই করা যায়।

আমার বন্ধু খালেদুর রহমান সৈকত, সাহেল আব্দুল্লাহ (এসএসি- ১৬ ব্যাচ) কে ফোন দিলাম ৩ তারিখে মাঠে নামা নিয়ে। আমি জানতাম সৈকতের সাথে খুব ভাল যোগাযোগ রয়েছে উসমানদের সংঘটিত গ্রুপটার। কথা বললাম তাদের সাথে সব কটা গ্রুপকে কিভাবে সমন্বয় করা যায় এ নিয়ে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে মেসেঞ্জার গ্রুপটা খুললাম এদিনই যেন পূর্বে সংঘটিত সবাইকে একটা জায়গায় আনা যায়। এদিকে তামিম জামান জানালো দক্ষিন জাংগিরাই একটা মিটিং হচ্ছে ৩ তারিখের অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে। তামিমকে বললাম মাহি (এসএসি-১৯) সহ তার ব্যাচের সবাইকে গ্রুপে এড করতে এবং আগামীকালের (৩ আগস্ট) কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ জনবল নিশ্চিত করতে চেষ্ঠা চালিয়ে যাওয়ার। 

ছোট ভাই ওয়াহিদুর রহমান অপু (এসএসসি-১৮) কুমিল্লা ভার্সিটির হয়ে আন্দোলনে যুবলীগের আক্রমনে অলরেডি আহত। তার সাথে কথা বলে, তার ফ্রেন্ড নুসরাত (টিচার, জুড়ী হেক্সাস) এর দ্বারা সংগঠিত কিছু মেয়েদেরকে সমন্বয় করা গেছিলো এবং তাদের একটা ভাল উপস্থিতি ও ছিলো। আমার সাথে নিশ্চিত হয়েছিলো সাবিহা (১৯ ব্যাচ) এবং খাদিজা (২৩ ব্যাচ) এরাও যাচ্ছে এদের ফ্রেন্ডসদের নিয়ে। 

মোটামুটি সবদিকেই ইনভাইটেশন চলে যায় সবাই সবার নিজ নিজ দ্বায়বদ্ধতা থেকে প্রস্তুত হচ্ছিলো এবং চেষ্টা করছিলো নিজের বন্ধু অথবা একটা হলেও ছোটভাই সাথে নিয়ে যাওয়ার।

গ্রুপে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো মিছিল শুরু হবে ৩ আগষ্ট দুপুর ২টায় নিউ মার্কেট থেকে। সেখানে বেলাগাঁও থেকে আসা ১৫ জনের একটা গ্রুপে তুহিন (২২ ব্যাচ) সহ আর অনেকে অপেক্ষা করছিলো। মিছিল শুরু হওয়ার ঠিক পূর্ব মূহুর্তেই নামে বৃষ্টি যার জন্য মিছিল শুরু হতে বিলম্বিত হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত আনুমানিক সোয়া ৩ টায় আল-শিফার সামনে থেকে মিছিলটি শুরু হয়, নিউ মার্কেট হয়ে জুড়ী নাইট চৌমুহনীতে আসে। ঠিক এখান থেকেই পূর্নাঙ্গ মিছিলটি জুড়ীর প্রধান সড়কটি প্রদক্ষিন করে পুনরায় নিউ মার্কেট প্রাঙ্গণে যেয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। সেখানেই সাংবাদিকদের সামনে অসহযোগ আন্দোলনের দাবীর কথা গুলো তুলে ধরা হয় মিডিয়ার সামনে।

সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ও দূর্ভাগ্যজনক হলো, ৩ আগষ্ট মিছিল শেষে সবাই যখন একা একা বাসায় ফিরা শুরু করলো, তখনই গর্তে থাকা ছাত্রলীগের ক্যাডাররা সশস্র হামলা করে। ৩ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়ে জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তী হয়ে চিকিৎসা নেয়।

এদিনের একটা ভাল লাগার বিষয় ছিলো; 

কিছু ছোটভাইদের নিয়ে আফসুস করতাম, এরা ছাত্রলীগের বাজে কালচারে বেড়ে উঠছিলো। ভেবেছিলাম এদের চোখ হয়তো খুলবে না কখনো, হয়তবা ভাল মন্দের বিচারবোধটা আসবে না এদের ভেতর। কিন্তু, আমি দেখেছি বেশ কতটা ছেলে সেদিন শিক্ষার্থীদের সাথে মিছিলে সামিল হয়ে গলা মিলিয়েছিলো "স্বৈরাচারী হাসিনার পদত্যাগ চাই, আমার ভাই হত্যার বিচার চাই"।

৪ আগস্ট, জুড়ীতে উল্লেখযোগ্য কিছু না ঘটলেও সারা দেশ উত্তাল ছিলো আন্দোলনের চূড়ান্ত দফা বাস্তবায়ন নিয়ে। এদিন মধ্যরাতে, ইউকে এক্স শিবির (মৌলভীবাজার শাখা) কতৃক জুম এ দীর্ঘক্ষণ মিটিং হয় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে। মিটিং থেকে বড় একটা ফান্ড সংগ্রহ করা হয় যেন আগত দিনের লড়াইয়ে আহতদের চিকিৎসা ও আইনি লড়াইয়ে সাপোর্ট দেওয়া যায়। মিটিং চলাকালীন, ঢাকা থেকে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর আসে ছাত্রলীগ, আওমীলীগ এর উচ্চপদস্থ অনেকেই ইতোমধ্যে দেশছাড়া শুরু করে দিয়েছে। তার মানে, আওমীলীগ এর পতন আসন্ন! 

১ দফা সফল করতে জাকে জাকে মানুষ ঢাকাতে প্রবেশ করছিলো, ফুটেজগুলো দেখছিলাম, আর গায়ে শিহরণ অনুভব করছিলাম। সারারাত অঘুমা থেকে একদম ভোরবেলা হালকা চোখ লেগেছিলো তখন দেশে, দশ/এগারোটা বাজে। একটু পরেই নাঈমের হটাত কলে ঘুম ভেংগে যায়, শুনি উচ্ছসিত কন্ঠে সে বলছে, "রায়হান, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, মিষ্টি খাবো টাকা পাঠা"। খবরটা শোনে কিছুটা আপ্লুত হই, পরে দু রাকাত সালাত আদায় করে নিই। সারাদেশে যেন তখন আনন্দের বন্যা বইছে। কবি নজরুল হয়ত আজকের দিনটার কথা ভেবেই লিখে গিয়েছিলেন, " হে জাতি, আজ উল্লাসে মেতে উঠো"। 

৩৬ জুলাইয়ের সেই একপ্রাণ হওয়ার আদর্শ, স্বৈরাচার নিপাতের সেই হুংকার জারি রাখতে হবে। আমাদের "ইনকিলাব" জিন্দা রাখতেই হবে।

লেখক: উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন, যুক্তরাজ্য