মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন থেকে সেগুন কাঠ চুরির অভিযোগে কলেজছাত্র সনির হোসেনের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে লাঠিটিলা বন বিটের বিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় মোট তিনজন'কে মামলা দেওয়া হয়েছে। তারা গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লালছড়া গ্রামের আসুক মিয়ার ছেলে মোঃ সনির হোসেন (২০) সে শিলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অন্যদুজন একই এলাকার মৃত আব্দর রহমানের ছেলে আব্দুল (২৮) ও লোকমান মিয়ার ছেলে বদর মিয়া (৩৮)।
মোঃ ছনির হোসেন অভিযোগ করে বলেন, এই গাছগুলো সরকারের সম্পত্তি। আমি একজন ভিলেজারের (বন জাগিদার) সন্তান হিসেবে এই বন রক্ষা করা আমার দায়িত্বে পড়ে। আমি বন বিভাগকে গাছ চুরির তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছি। তিনি চোরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টা আমার উপর কেন মামলা দিবে! নিশ্চয় বিট অফিসার আমাকে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। আমি গাছ চুরির তথ্য দিয়েছি বন বিভাগ চুরির সাথে জড়িত প্রকৃত চোরদের মামলা দেওয়ার কথা। আমি তো চুরির সাথে জড়িত নয়। আমাকে কেন মামলায় জড়ানো হলো। এই মামলার জন্য ঈদের আগের দিন থেকে আমি ১৫ দিন জেলে ছিলাম। এখন আমার পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটছে। এখন পড়ালেখা করতে না পারলে আমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার চাই। এবং প্রকৃত চোরদের আইনের আওতায় আনা হোক।
জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে লাঠিটিলা বনের গলা চিপা ও দশের টিলা থেকে ১৫ টি'রও বেশি সেগুন গাছ চুরি হয়েছে। এছাড়াও ১৫ /২০ টি সেগুন গাছ রিং পদ্ধতিতে মারা হয়েছে। এই বিষয়টি লাঠিটিলা বিট কর্মকর্তা অবগত হওয়ার পরে বিষয়টি বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে না জানিয়ে স্থানীয় কয়েকজন নিয়ে বিষয়টি সমাধান করেন। ১৫ টির ও বেশি গাছ চুরির ঘটনায় বন বিভাগ অপরাধীদের আইনের আওতায় নেওয়ার কথা থাকলেও বিষয়টি অজ্ঞাত রয়েছে।
এই ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে পুরো এলাকা জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পর নির্ভর যোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, লাঠিটিলা বন বিটের দায়িত্বে থাকা বিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম পুরো ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করেন। এমনকি ১ মাস পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে তৎকালিন সময়ে বন বিভাগের ঊর্ধতন কতৃপক্ষ'কেও ঘটনাটি জানানো হয়নি। এভাবে সংরক্ষিত বনের গাছ চুরি হলে এক সময় পুরো বন উজাড় হয়ে যাবে মনে করেন ভিলেজার রা। এবিষয়টি বিট কর্মকর্তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সচেতন কয়েকজন বন জাগিরদার বিষয়টি গণমাধ্যমকে অবগত করেন।
এরপর সাংবাদিকরা বিষয়টি যাচাই করে গাছ চুরির স্থানটি পরিদর্শন করে সত্যতা নিশ্চিত করেন। সরজমিনে দেখা যায়, প্রায় ১৫ টি বড় ও মাঝারি আকৃতির সেগুন গাছ উধাও। আরো বেশ কয়েকটি শেকড় সহ মাটি থেকে তোলে ফেলা হয়েছে। চুরি হওয়া মূল কাঠগুলো পাচার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে চুরির হওয়া সেগুন কাঠের কোন অংশ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি বিট কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিক'কে বনে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করার দায়ে মামলা দেওয়ার হুমকি দেন! তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোন ধরনের নিউজ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন। অথচ, গাছ চুরের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে কেন এসব কথা বলেছেন বিষয়টি স্পষ্ট! গাছ চুরির সাথে জড়িত মূল আসামীরা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। বন বিভাগ এভাবে দায়সারা থাকলে এই বনের গাছ গুলো চুরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এ বিষয়ে জুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইন বলেন, ছনির হোসেন নামে যে ছেলেটাকে আসামি করা হয়েছে, সে আমার অফিসে এসেছিল। বিষয়টি আগে জানলে মামলা কোর্টে পাঠানোর আগে চার্টসিট থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল। এখন আর সুযোগ নেই। মামলায় তাঁর যে নাম দেওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে কোন মিল নেই। সে গাছ চুরির তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে এটা ভালো কাজ করেছে। এজন্য তাঁকে মামলা দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি বলে দিয়েছি কোর্ট থেকে তার নামে সমন আসলে এটা গ্রহণ না করার জন্য। লাঠিটিলা বিট কর্মকর্তাকে আমি অফিসে ডেকে জিগ্যেস করেছিলাম কেন ছেলেটাকে মামলা দিলেন? তিনি বলেছেন, আমার ভুল হয়ে গেছে আমি যাদের কাছে শুনেছিলাম তারা বলছেন সনির হোসাইন জড়িত ছিল।
এই মামলায় উল্লেখিত প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী ফরেস্ট গার্ড আব্দুস সাকুর বলেন, ছনির হোসেন সে গাছ চুরির সাথে জড়িত নয়। যারা প্রকৃত চুর তাঁরা মামলা থেকে বাদ পড়েছেন। প্রকৃত গাছ চুরির সাথে জড়িতরা কোনভাবে যেন মামলা থেকে ছাড় না পায় এদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। এ ব্যাপারে ফরেস্ট গার্ড আব্দুস শুক্কুর জানান, এই মামলায় কেন তাঁকে জড়িত করা হয়েছে আমি জানি না। বিট অফিসার মাজহারুল ইসলাম আমাদের বস তিনি যাকে মামলা দিবেন আমরা বাধ্যতামূলক মামলায় স্বাক্ষর করতে হয়।
লাঠিটিলা বন বিটের দায়িত্বে থাকা বিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, এলাকার কিছু মানুষের থেকে তার নাম নিয়ে তার উপর মামলা দিয়েছি। মামলা যেহেতু হয়েগেছে সে জেলে আছে ঐ ছেলেকে কিভাবে সাহায্য করা যায় এই ব্যাপারে বুদ্ধি দেন।
গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা নিজের চোখে কাউকে না দেখলে তাঁকে চোর বলতে পারবো না। কিছু জিনিস চুরি না হলেও বন বিভাগ ধরে নেয়ে এটা চুরি।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটি একটি অমানবিক এবং অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। ছেলেটা মিথ্যা মামলায় জেল খাটছে এটা তো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। একজন নিরপরাধ মানুষকে তো সাজা দিতে পারে না। তাকে মামলা থেকে কিভাবে অভ্যাহতি দেওয়া যায় বিষয়টি বিবেচনা করবো। এটা তো মজা করার বিষয় নয়, বিট কর্মকর্তা যাচাই বাছাই না করে কেন এমন ভুল করবে। এবিষয়ে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
জুড়ীরসময়/খোর্শেদ/হোসাইন