খোর্শেদ আলম::
মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা জুড়ে অবস্থিত পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্ট। সিলেট বিভাগের মধ্যে এই বনটি এখনও বেশ সমৃদ্ধ। ভারত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী সীমারেখার মধ্যে চারটি বন বিট নিয়ে পাথারিয়া বনটি অবস্থান।
এই বনের পূর্ব দিকে ভারতের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে কিছু মানুষের বসতি। পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্ট নামটি অনেকের কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের কথা কমবেশি দেশের ছোট বড় সবাই জানে। এই মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে অবস্থিত। পরিবেশগত ভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র হটস্পটের একটি অংশ।
পথারিয়া বনে অবাধে ঘুরেবেড়ানো একটি মায়া হরিণ। ছবি: বন বিভাগের সুফল প্রকল্পের ক্যামেরা ট্রাপিং থেকে নেওয়া।
এই বনকে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২০ সালে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। যেখানে ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ছিল ১ হাজার ১৫২ বর্গকিলোমিটার। সেখানে মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। বাকি অংশ পড়েছে ভারতে। এক সময় পাথারিয়ায় বুনো মোষ, বাঘ, পারবতি হরিণ, গন্ডার সহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণী ছিল। গত দুই বছর আগে ক্যামেরা ট্রাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০০৭ সালে বনের সুরমা বাঁশমহাল নামক এলাকায় চিতা বাঘের আক্রমণে একটি গরু মারা গেছে। তখন গরুর মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে মৃত গরুটির শরীরে বিষটোপ প্রয়োগ করেন। সেই শিকারি চিতাবাঘটি মৃত গরুটির মাংস খেতে এসে বিষটোপ খেয়ে মারা যায়। বিষয়টি হঠাৎ মধু শিকারির দৃষ্টিগোচর হয়। তারপর লোকমুখে জানাজানি হলে বাঘটি দেখতে এলাকার উৎসুক মানুষ ভিড় জমায়। মধু শিকারি ও উৎসুক জনতা এক পর্যায় বাঘটিকে স্থানীয় দিলখুশ বাজারে নিয়ে আসেন। পরে বন বিভাগ খবর পেয়ে বাঘটি তারা উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে স্থানীয়দের চোখে বাঘ দেখা কিংবা বাঘে গরু ধরার এমন দৃশ্য কখনও চোখে পড়েনি।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে সম্প্রতি এই বনে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মাঝারি মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে সোনালি বিড়াল ও মেছো বিড়ালের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এগুলো দেখে কিছু আনন্দিত হলেও চিতাবাঘ অথবা মেঘলা চিতার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় মধু শিকারিরা জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সনের দিকে ভারত থেকে এক দল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশের অংশে প্রবেশ করে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমান সহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণী শিকার করেছে। এবিষয়ে তখন বন বিভাগ নিরব ভূমিকা পালন করে।
সিলেট বিভাগের একমাত্র বন যেখানে মাত্র চারটি মেয়ে বন্য হাতি জীবনের সাথে সংগ্রাম করে আজও এই বনে টিকে আছে। কখন ও বনে তাদের তাঁজা পদচিহ্ন দেখে আমরা আবেগআপ্লুত হয়ে যাই। বুনো হাতি গুলো আজ মানুষের পৃথীবিতে দুই দেশের কাঁটাতারে বাধার সম্মুখীন। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। খাবার হজম হয় না যেভাবে খায় সেভাবে পায়খানা করে। কিছুদিন আগে জামকান্দি এলাকার একটি সবজি বাগানে এই দৃশ্যটি দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন সব সময় এমন দেখা যায়। পুরুষ হাতি না পেলে খুব শিগ্রই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে! হাতি গুলোর বিলুপ্ত ঠেকাতে এখনই প্রয়োজন একটি পুরুষ হাতি।যে কারণে বন্যপ্রাণী এখন হুমকির মুখে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্য করে দেখা গেছে, বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সাথে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণীরা মারছে নিয়মিত। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে। বনের মূল ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন করেছে। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে স্থানান্তর হওয়ায় বন্যপ্রাণীরা তাঁদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে। বনের যে স্থানটি ছিল প্রাকৃতিক ভাবে বেশ সমৃদ্ধ। ২০২০ সনে যে স্থানে একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল চার টি উল্লুকের পরিবার। কিন্তুু, বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ কাটা পড়েছে, এবং লতাগুল্ম গুড়া কেটে ফেলার কারণে তাদের খাবারের সংকট দেখা দেয়।এসব কারণে বর্তমানে তারা হুমকির সম্মুখিন। সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই একালায় কোন বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি তেমন দেখা মিলে না। কখনো ফিরে আসবে কি তার ও কোন নিশ্চিয়তা নেই। ফল শূন্য আকাঁশমনি গাছ দিয়ে বনায়ন করায় বন্যপ্রাণী জীবন যাপন করা খুব কঠিন হয়ে দাঁয়িয়েছে। বন্যপ্রাণীকে ঠিকিয়ে রাখতে হলে তাদের আবাস্থল সংরক্ষণ করা জরুরি।
এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনও টিকে আছে, সঠিক ভাবে তা সংরক্ষণের আওতায় আসলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরাকারবারিদের দমন করা এখন সময়ের দাবি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এম এ আজিজ বলেন, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্য প্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। অতীতে কতটুকু কী হয়েছে, সেদিকে আমাদের তাকিয়ে আর লাভ নেই।আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। পাথারিয়া পাহাড় রক্ষা করতে না পারলে অতীতে নানা জাতের বুনো প্রাণীদের মেলা ওই বনে। পাহাড়ের ঘন জঙ্গল থেকে হাওরের সমতল এলাকায় নেমে আসত বুনো মোষ, জলার হরিণ আর গন্ডার। ফলে শিকারিরা এসব প্রাণী খুব সহজেই শিকার করতে পারত। অতীতের সেই পাথারিয়া বনের বিরল প্রাণপ্রকৃতির ইতিহাস আমরা কতটুকুই–বা জানি। আজও এ বনে প্রাণপ্রকৃতির যেটুকু টিকে আছে, তা–ও আমাদের কাছে প্রায় অজানা। এ আমাদের বড় দৈন্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিচারালয়ে দাঁড়াতে হবে।
জুড়ীরসময়/খোর্শেদ/হোসাইন