যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জুড়ীর এহসানুল করিম



আশরাফ আলী::

এহসানুল করিম হাসানের বাড়ী মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলায়। তার পিতা বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম মোহাদ্দিস। ছোটবেলা থেকে কওমী মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। বর্তমানে অবস্থান করছেন আমেরিকায়। চাকরি করেন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কঠোর পরিশ্রম আর মনোবল তাকে নিয়ে গেছে এই জায়গায়। 

এহসানুল করিম হাসান বলেন, আমি ১৯৮৯ সালে ভোগতেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করি। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসা জামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসায় ভর্তি হই। সেখানে ছম (তৃতীয়) শ্রেণী থেকে ছরফ পর্যন্ত পড়ি। সেখান থেকে চলে আসি মৌলভীবাজারের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসা রায়পুর মাদরাসায়। সেখানে নহমীর থেকে কাফিয়া শরীফ পর্যন্ত পড়ি। ১৯৯৫ সালে আবারও চলে যাই জামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসায়। শরহে জামী থেকে দাওরা হাদীস শেষ করি ২০০১ সালে।

তিনি বলেন, আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছে ছিল আমি একজন মাওলানা হব। মাওলানা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আমার প্রথম চাওয়া ছিল। এবং এর পাশাপাশি বড় কিছু করা। 

তিনি আরও বলেন, আমি ও আমার পরিবারের সকল সদস্য ২০০১ সালে আমেরিকা যাই। এরপর থেকে সেখানে বসবাস করছি। তারপর সেখানে ২০০২ এসোসিয়েট অব আটর্স এডুকেশন কোর্সে ভর্তি হই। ২০০৪ সালে ওয়াইন কাউন্টি কমিউনিটি কলেজ থেকে দুই বছর মেয়াদি কোর্সটি সম্পন্ন করি। তারপর ওয়াইন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও কম্পিউটার সাইন্স থেকে ৪ বছর মেয়াদী গ্রেজোয়েশন সম্পন্ন করি। ২০১৩ সালে একই বিশ^বিদ্যায় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করি।

দেশে কিছু করতে চান কি-না এ প্রশ্নের জবাবে এহসানুল করিম হাসান বলেন, ইচ্ছে ছিল কিছু করার। কিন্তু স্বপরিবারে প্রবাসে চলে যাওয়ায় সেটি করা সম্ভব হয়নি। তবে আমার শিক্ষকতা করার আগ্রহ বেশি ছিল। শিক্ষকতা  ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্র্যন্ত করি। বাংলাদেশে আমরা একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছি। এখান থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যাতে তারা দেশের জন্য কাজ করতে পারে। দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে।

কওমী মাদরাসায় পড়ালেখা নিয়ে তিনি বলেন, কওমী হচ্ছে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা। আমি বলব কওমী মাদরাসার পড়ালেখার মান অনেক ভালো। এখানে আলাদা গাইড লাইন দিয়ে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের এখানে পাঠ্য বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় পড়তে হয়। যার জন্য কওমী মাদরাসায় পড়া শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। 

তিনি বলেন, আমি যখন কওমীতে পড়ালেখা করি তখন কোন সময়ই আমি রোল ১০ ভিতরে থাকতে পারিনি। এখানে রোল নাম্বারে মার্কের খুব কম ব্যবধান থাকতো। তাই আমি বলি কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে মেধাবী। আর এদেরকে নিয়ে উচু স্বপ্ন দেখি, খুব উচু।

তিনি আরও বলেন, কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা রোটিন মেনে পড়ালেখা করে। ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠে তারা তাদের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করে। সকাল ১০টার ভেতরে সকালের খাবার, গোসল শেষ করে ক্লাসের জন্য রেডি হয়। তারপর ক্লাস শেস করে দুপুরের খাবার। আছরের পর কেহ খেলাধূলা, কেহ লাইব্রেরীতে সময় ব্যয় করে। মাগরিবের পর থেকে পড়ালেখা শুরু করে। রাতের খাবার খেয়ে রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। আর নিয়মিত রুটিন না মেনে চললে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়।

কওমী মাদাসার ছাত্রদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি বলেন, আমি কওমী মাদরাসায় পড়েছি। আমি যেহেতু কওমী মাদরাসায় পড়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছি তাহলে বাকী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। অবশ্যই কওমীতে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীরা অন্যদের তুলনায় এগিয়ে আছে এগিয়ে থাকবে। এবং তাদের ভবিষ্যত উজ্জল।

তিনি বলেন, আমি কওমী মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। এটা ঠিক আমাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা হত। আমাদের বলা হত আমরা ছাত্র হিসেবে সুবিধার নয়। আমাদের খুব একটা দাম দেওয়া হত না। কোন ধরণের পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের হেয় করা হতো। মাদরাসার ছাত্র দেখে বিচার করা হত। অথচ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ালেখা করে। তাদেরকে ৩টি ভাষায় পারদর্শী হতে হত। যারা এরকম করে তাদের এই কাজগুলো ভালো নয়। আপনি কোন ধরণের পরীক্ষা ছাড়া ঢালাও ভাবে এধরণের বিচার করতে পারেন না। 

তিনি আরও বলেন, আমি যখন মাদরাসায় পড়তাম তখন বহুবার নিগ্রহের স্বীকার হয়েছি। তবে আমি দমে যাইনি। আমার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। যার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছি। এরপর সফল হয়েছি। এখন অনেকেই আমাকে দেখে তাদের ছেলে-মেয়েদের কওমী মাদরাসায় পাঠাচ্ছে পড়ালেখার জন্য। এটাই আমার  সফলতা। মানুষ ধর্মের দিকে ঝুকছে। আমি বলব মাদরাসায় পড়ে যারা নিগ্রহের স্বীকার হচ্ছেন তারা তাদের মনোবল আরও মজবুত করতে হবে। এবং সেই সাথে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে।

আমেরিকার পেশাগত জীবন নিয়ে তিনি বলেন, আমেরিকায় যাবার পর প্রথমে কার কোম্পানির সিট বেল্ট তৈরি করে এরকম একটি কোম্পানিতে কাজ করি। এরপর ২০০৪ সালে এডুকেশন কোর্স করে চাকরি শুরু করি ডেট্টয়েট বোর্ড অব এডুকেশনের প্রোগ্রাম এডমিনিস্টেটর হিসেবে। সেখানে ৫৪টি স্কুলের বিভিন্ন অনুদান নিয়ে কাজ করতে হত। যা আসতো ফেডারেল এবং স্টেট গভর্মেন্ট এর কাছ থেকে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে চাকরি করি। এরপর ২০১৪ সালে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে গভীরভাবে কিছুদিন পড়াশুনা করি। একই বছরে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি শুরু করি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই চাকরি করি। ২০২০ সাল থেকে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পাই। বর্তমানে সেখানে কর্মরত আছি।

মাদরাসার ছাত্র হয়েও কিভাবে সেখানে সফল হলেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সফল হতে হলে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম। আমি পরিশ্রম না করলে এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হত না। তাই সফল হতে হলে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আর সফল হতে হলে পরিশ্রমের পাশাপাশি মনোবল রাখতে হবে। আমি পারব এই মানসিকতা রাখতে হবে। এটা না রাখলে আপনি ব্যর্থ হবেন। আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না। মধ্যপথ থেকে বিচ্যুত হবেন।

জুড়ীরসময়/ডেস্ক/এএ