জুড়ীর সংরক্ষিত বনে নিষিদ্ধ আঁকাশমনি দিয়ে বাগান!

জুড়ীর সংরক্ষিত বনে নিষিদ্ধ আঁকাশমনি দিয়ে বাগান!


রিপন দে::

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সংরক্ষিত পাথারিয়া রিজার্ভ ফরেস্টের লাঠিটিলা বনে লাখো প্রাকৃতিক গাছ বাঁশ কেটে আকাশমণি গাছ রোপণ করে বনায়ন করছেন বনবিভাগ। প্রাকৃতিক গাছ কেটে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আকাশমণি গাছ লাগিয়ে বনায়ন করাকে লুঠপাটের অংশ বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনে সিলেট বিভাগের পূনঃবনায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প “উডলট বনায়ন” এর আওতায় ১৫ হেক্টর জায়গাতে ৩৭৫০০টি গাছ লাগিয়েছে বনবিভাগ। প্রকল্পে চিক-রাশি, আকাশমণি, গামারি, কালোজাম, কদম, শিল কড়ই ইত্যাদি গাছ লাগানোর কথা থাকলে শুধু আকাশমণি গাছ লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরণের গাছ লাগানো কথা থাকলেও লাগানো হয়েছে শুধু আকাশমণি। আর এই বনায়নের জন্য প্রাকৃতিক ভাবে বনে থাকা নানা জাতের উদ্ভিদ, বনের আদি গাছ এবং মুলি বাঁশ কাটা হয়েছে।

একইভাবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বেলবাড়ী এলাকায় মোট ৬৫ হেক্টর বাগান করা হয়, এখানে ৪৫ হেক্টরই আকাশমণি এবং একই বিটের সমনভাগ বিটের সংলগ্নে অবস্থিত বেকি হান্ডর এলাকায় উডলট বাগানে প্রায় ১৫ হেক্টর এবং সুফল প্রকল্পের আরও ১৫ হেক্টর যায়গাসহ ঐ বিটে মোট ৭৫ হেক্টর বাগান করা হয়েছে যার বেশীরভাগ আকাশমণি গাছ দিয়ে বাগান করা হয়েছে। তবে স্থানীয় সূত্রে পাওয়া এসব তথ্যের বিপরীতে বনবিভাগ কোন পরিসংখ্যান দিতে পারেনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ সংরক্ষিত বনে গাছ লাগানোর জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পূর্বের প্রাকৃতিক লতাপাতা, উদ্ভিদ বন্যপ্রাণীর খাবার যোগান দেয় এমন ফলের গাছ এবং বাঁশ।

খুজ নিয়ে জানা যায়, ন্যাচারাল বন ও সুরমা বাঁশমহালের লক্ষাধিক বাঁশ কেটে প্রথমে আগুন পুড়ানো হয়েছে, এর পরে এখানে গাছ লাগানো হয়েছে। যেসব জায়গায় বনায়ন করা হয়েছে তার বেশীরভাগ ছিল আগে থেকেই ঘন বন। সেই সব নির্বিচাররে উজাড় করে তা পুড়িয়ে ফেলে পরে গাছ লাগানো হয়েছে।

সংরক্ষিত বনের প্রাকৃতিক গাছ নষ্ট করে কোটি কোটি টাকা খরচ এভাবে বনায়নকে লুটপাটের অংশ এবং বন ধ্বংসের পায়তারা বলে মনে করছেন পরবিবেশবাদীরা। এমনকি খুদ বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এটা খুবই খারাপ কাজ হয়েছে। আকাশমণি লাগাতে আপত্তি নাই তবে মৌখিক ভাবে বলে দেওয়া হয় যেনও ২০ শতাংশের বেশী না হয়। আকাশমণি লাগালে পাখিরা এইসব গাছে বসেনা। অন্য প্রাণীরাও আসেনা।  একটি সমৃদ্ধ বনের গাছ কেটে এভাবে বনায়ন করার কারণে বন্যপ্রাণীদের ক্ষতি হল। এখানে যে সব বন্যপ্রাণীরা থাকত তারা অন্যত্র চলে যাবে।

ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মুনতাসির আকাশ জানান, এভাবে বনের আদিগাছ-বাশ কেটে বনায়ন করলে প্রানীদের আবাস্থল নষ্ট হয় বিশেষ করে বাশভাল্লুক, মার্টিনসহ বেশ কিছু প্রানী আছে এই এলাকায় যারা বিপন্নের কাছাকাছি শুধু এরা না। এরা ছাড়া অনেক সরিসৃপের বাসস্থান থাকতে পারে। সংরক্ষিত বনে যদি তাদের আবাস ঠিক না থাকে তাইলে আর কোথাও থাকার কথা না।

বনবিভাগের জুড়ী রেঞ্জের মোঃ আলাউদ্দিন জানান, ২০-২১ অর্থবছরে এই বনায়ন করা হয়েছে এখানে সুফলসহ বিভিন্ন প্রজেক্টের অধীনে বনায়ন করা হয়েছে চলতি অর্থ বছরেও কিছু বনায়ন করা হবে। আকাশমণি গাছের ব্যাপারে তিনি বলেন শুধু আকাশমণি না সব ধরণের গাছ লাগানো হয়েছে। বনায়ন করতে গিয়ে সংরক্ষিত বনে এভাবে ধ্বংস করতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন আমরা বাঁশ -গাছ তেমন কাটিনি কিছু ঝোপঝাড় কেটেছি। স্থানীয়রা বাড়িয়ে বলছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, বনায়ন করতে গিয়ে সংরক্ষিত এই বনের প্রচুর গাছ কাটা হয়েছে। ছোট ছোট বিভিন্ন গাছ যেগুলো বাংলাদেশের আদি গাছ হিসেবে পরিচিত, ঝোপঝাড়সহ কয়েক লাখ বাঁশ কাটা হয়েছে এবং সেই গাছ সে স্থানেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সব চেয়ে বেশী বাঁশ কাটা হয়েছে সুমরা ও হলম্পা বাঁশমহালে। এখানে এত ঘন বাঁশবন ছিল যে ভেতরে ঢুকা যেত না কিন্তু কেটে পুড়িয়ে ছাইয়ের স্তপ বানানো হয় পওে সেখানে গাছের ছাড়া লাগানো হয়।
জুড়ীর সংরক্ষিত বনে নিষিদ্ধ আঁকাশমনি দিয়ে বাগান!


জামালি গ্রামের জামাল মিয়া জানান, এখানে বনের গাছ বাঁশ কেটে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে । তবে গাছগুলো ছোট ছোট এইগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নিয়েছিল। এত বাঁশ কাটা হয়েছে যে তা কয়েক লাখ হবে।

এইদিকে লাঠিটিলা বনের হায়াছড়া গ্রামের নরুল ইসলাম জানান, আগে এখানে প্রচুর পাখি বসত এখন আকাশমণি গাছ লাগানোর কারণেও পাখি আসেনা।

সংরক্ষিত বনের বনায়ন করা যাবেনা এবং একটি লতাও কাটা যাবেনা জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপার) কার্য নির্বাহী সদস্য ও সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম জানান, বনবিভাগের উপর থেকে নিজ পর্যন্ত বেশীরভাগ কর্মচারী কর্মকর্তা বনবিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। লাঠিটিলা একটি সমৃদ্ধ ও সংরক্ষিত বন। এই বনের প্রাকৃতিক গাছ বাঁশ কেটে বনায়ন করার কি প্রয়োজন? প্রয়োজন লুটপাটের জন্য। সুফলসহ বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে বনবিভাগ যত আগ্রহী তার ১ শতাংশ যদি বন রক্ষার প্রতি থাকত তবুও কিছুটা সান্তনা মিলত। আমরা কার কাছে প্রতিবাদ করব? এই বনতো পরিবেশ মন্ত্রীর নিজের নির্বাচনী এলাকা। নিজের এলাকায় যদি বন ধ্বংস করা হয় এই মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা কি আসা করতে পারি?

এই দিকে কতটুকু জায়গায় এই বনায়ন হচ্ছে এবং কতটা প্রকল্প সেই হিসেব দিতে পারেননি স্থানীয় ও বন কর্তারা। তারা দায়ও নিতে চাইছেন না।

বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (সিলেট)  মো. তৌফিকুল ইসলাম জানান, আমি নতুন যোগাদান করেছি তাই বিস্তারিত জানিনা। তবে এভাবে বন ধ্বংস করে বনায়ন করার যুক্তি নেই। আমি আজকেই খুঁজ নেব এবং এখানে বনবিরোধী কিছু হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেব। 

উল্লেখ্য, ধারণা করা হয় এই বণে ২০০ প্রজাতির প্রাণী আছে। এটি সিলেট বিভাগের একমাত্র বন যে বনে হাতির দেখা মিলে। মৌলভীবাজারের শহর থেবে ৬০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সিলেট বন বিভাগের জুড়ী ফরেস্ট রেঞ্জের লাঠিটিলা পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের একটি অংশ। লাঠিটিলার আয়তনই ২০ বর্গ কিলোমিটার।

জুড়ীরসময়/আরডি/সাইফ