"মায়ের প্রতীক্ষা"


রায়হানুল ইসলাম::

ভোর চারটা। সারারাত মরিয়ম বিবির চোখে ঘুম নেই। চোখে ঘুম না থাকলেও মনে আনন্দের বন্যা বইছে। কারণ ছেলে যে তার আজ প্রায় আট মাস পর বাড়ি ফিরছে। হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। এতদিন পর ছেলে বাড়ি ফিরছে! এসে না আবার দুই মিনিট দরজায় দাঁড়াতে হয়, তাই শরীর ক্লান্ত হলেও ঘুম লাগলো না মরিয়ম বিবির। 


সারাদিন কি যে ধকল গেলো কিন্তু আনন্দচিত্তে কাজ করলেন। পাশের বাড়ির জমির কে দিয়ে পুকুরে জাল ফেলে অনেক মাছ ধরিয়েছেন। রুদ্র আবার মাছ খুব পছন্দ করে। মুরগী,গরুর মাংস এইসবে তার খুব একটা আগ্রহ নেই। শুটকি মাছ ও তার খুব পছন্দ তাই সেটা রান্না করতেও ভুল করেননি মরিয়ম বিবি। বিভিন্ন ধরনের পিঠা করেছেন সারাদিন রহিম মোল্লার মেয়ে আমেনা কে নিয়ে। 


আমেনা মেয়েটাকে তার খুব পছন্দ। এই গ্রামে আমেনার মত এত লক্ষী মেয়ে আর একটাও নাই। আমেনাকে মনে মনে রুদ্রের বউ হিসেবে ভেবে রেখেছেন মরিয়ম বিবি। তিনি আর কয়দিন! ছেলেটাকে সুখী দেখে মরতে চান। আমেনার আগ্রহ দেখে তিনি বুঝতেই পারলেন উনার ছেলের জন্য শুধু তিনিই নন আমেনাও অপেক্ষায় আছে। রুদ্রের বাবা মারা যাবার পর রুদ্র টিউশন করে করে যা টাকা পাঠায় তাতে মরিয়ম বিবির কষ্ট হলেও কোনরকম চলে যায়। 

আর মাত্র কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে রুদ্র ছোটখাটো একটা চাকরি পেলেই রহিম মোল্লার কাছ থেকে আমেনাকে চেয়ে নিবেন তিনি। আমেনা প্রায় রাতে মরিয়ম বিবির সঙ্গেই থাকে। আজ আর থাকলো না। অনেক গরম পড়েছে তাছাড়া বাস থেকে নেমে প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে বাসায় আসতে হবে রুদ্রকে। তাই রুদ্র আসলেই যেন শরবত দেয়া হয় সেজন্য আমেনা নিজ হাতে লেবু কেটে রেখে গেছে। কেন যে এত দেরি হচ্ছে বুঝতে পারছেন না মরিয়ম বিবি। যদিও বাসে ওঠার আগে কল করেছিল রুদ্র। 

একবার ভাবলেন একটা কল দিবেন কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলেন ছেলেটা হয়তো বাসে ঘুমিয়ে পড়েছে। রুদ্রকে অবশ্য আজ সারাদিনই পাশে পাবেন তিনি। বাড়িতে আসলে প্রথম দিন কোথাও বের হয়না সে। সারাদিন মায়ের সাথেই গল্প করে। এরইমধ্যে কাল নাকি অনেক দোকান ঘুরে মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছে ৫০০ টাকা দিয়ে। ছেলেটা কেনো যে এই পয়সাগুলো নষ্ট করে তা তিনি বোঝেন না। তার কি কাপড় চোপড়ের অভাব আছে নাকি!ভাবতে থাকলেন ছেলে আসলে কি কি করবেন। প্রথমে হয়তো শরবত দিবেন রুদ্রকে। তারপর রুদ্র পুকুরে গিয়ে গোসল করবে। তার আবার পুকুরে সাঁতার কাটার খুব শখ। 

তারপর ছেলেকে নিজে পাশে বসে ভাত বেড়ে খাওয়াবেন। হোস্টেলে কি খায় না খায়! মায়ের হাতের রান্না কি আর পাওয়া যাবে!ছেলেটা অনেক সংগ্রাম করে বেঁচে আছে মাকে নিয়ে। কখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হবে আর দরজা খুলে ছেলেকে দেখবেন অপেক্ষায় আছেন মরিয়ম বিবি। অপেক্ষার সময় গুলো সত্যিই অনেক দীর্ঘ হয়। হঠাৎ মোবাইলের রিং বাজার শব্দে বাস্তবে ফিরলেন মরিয়ম বিবি।নিশ্চয়ই রুদ্র কাছাকাছি চলে এসেছে,তার সুখের মুহূর্তগুলোও এগিয়ে আসছে। কলটি রিসিভ করলেন --"ঢাকা সিলেট রুটের এনা বাসটি কিছুক্ষণ আগে মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে। এই মোবাইলটি যার পকেট থেকে পাওয়া গেছে তিনি নিহত হয়েছেন। আমরা..........."

মরিয়ম বিবির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।তার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। লোকটা আরো কি যেন বলছিল। শরীরটা অবশ হয়ে আসছে মরিয়ম বিবির,চোখ দুটো বুজে আসছিল তার। শোকে স্তব্ধ বিধ্বস্ত এক মায়ের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।একটা মাত্র সন্তানই ছিল তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন। এখন সে কি নিয়ে বাঁচবে। পৃথিবীটা মুহূর্তেই অর্থহীন হয়ে পড়লো মরিয়ম বিবির। বুক ফাটা কান্নায় যেনো পাথর হয়ে পড়েছেন মুহূর্তেই।এক সন্তানহারা মায়ের অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে অনবরত। ঠিক তখনই দরজার কড়া নড়ল। মরিয়ম বিবি দরজার কাছে যাওয়ার শক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছেন। স্তম্ভিত,নির্বাক মরিয়ম বিবি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজা খোলার পরে যে কী দেখলেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। মোবাইলে তাহলে কি শুনলেন! এই কি তার রুদ্র? এই কি তার ছেলে রুদ্র। মরিয়ম বিবির মুখ থেকে কোনও কথা বের হচ্ছে না। তিনি রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন এমনভাবে যেনো, নিজের ছেলেকেই চিনতে পারছেন না!

রুদ্র বলছে,"তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলে!আমি আমার মোবাইলটি বাসে হারিয়ে ফেলেছি তাই তোমাকে কল করতে পারি নি।বাস থেকে নামার সময় কেউ হয়তো এটা নিয়ে নিয়েছে।তুমি কেমন আছো, মা?


লেখক:

প্রভাষক ইংরেজি বিভাগ

উইমেন্স মডেল কলেজ, সিলেট