'মায়ের শিক্ষা'


মোঃ শরীফ উদ্দিন ::
বাংলাদেশে হাতে গুনা যে কয়েকজন প্রাবন্ধিক আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মোতাহের হোসেন চৌধুরী। তিনি তার সংস্কৃতি কথা প্রবন্ধ গ্রন্থে লিখেন ‘কোন ভারি জিনিসকে উপরে তুলতে হলে তাকে নিচের থেকে ঠেলতে হয়, আবার উপর থেকে টানতেও হয়; শুধু নিচের থেকে ঠেললে তাকে আশানুরুপ উপরে ওঠানো যায় না। মানব উন্নয়নের ব্যাপারে শিক্ষা সেই উপর থেকে টানা আর সুশৃংখল সমাজব্যবস্থা নিচের থেকে ঠেলা ।’

লেখক বুঝাতে চেয়েছেন শুধু সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা মানব উন্নয়নে সম্ভব নয়; এর জন্যে চাই শিক্ষা। মানব উন্নয়নের একমাত্র নিয়ামক শিক্ষা।

একটি শিশুকে শিক্ষিত করে প্রকৃত মানুষ করতে যিনি উপর থেকে টানেন তিনি হচ্চেন 'মা'। আর নিচের থেকে ঠেলার কাজ করে প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয় বা শিক্ষক। যত ভালোই প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন মায়ের টান ছাড়া সন্তানের শিক্ষা অর্জন অপরিপূর্ণ।

জন্মের পর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমরা যে ভাষায় কথা বলতে শিখি তাকে বলি মাতৃভাষা। মায়ের মুখে শুনে শুনে শিখি বলেই বলি মাতৃভাষা। যেই মা ছাড়া আমাদের ওই ভাষা শিখা হয়ে উঠে না সেই মা ছাড়া শিক্ষা অর্জন আসলে অসম্ভব।
শিক্ষা অর্জনের মানে শুধু এম.এ, এমএসসি পাস করা নয়, শিক্ষা মানুষকে নৈতিক করে, সহনশীল করে, শিক্ষার মাধ্যমে পরমত সহিষ্ণুতা, মূল্যবোধ অর্জন করা যায়। শিক্ষাকে শুধু প্রতিষ্ঠানের গন্ডির ভিতরে দেখলে চলবে না। দেশে ডিগ্রিধারি লোকের অভাব নেই, কিন্তু যদি নৈতিকতা মাপার কোন যন্ত্র থাকত তাহলে দেখা যেত এই উচ্চ শিক্ষিত লোকদের নৈতিকতা কোন পর্যায়ের।

শুধু প্রতিষ্ঠান মানুষকে প্রকৃত পক্ষে শিক্ষিত করতে অক্ষম। প্রতিষ্ঠান নিচের থেকে ধাক্কা দেয়ার মত; এটা তখনই কাজে লাগবে উপর থেকে কেউ যখন টানবে। উপর শূন্য রেখে শুধু নিচের থেকে টেললে বস্তু উপরে না গিয়ে নিচের দিকে আসার সম্ভাবনা বেশি।

এজন্য, মা যদি প্রকৃত শিক্ষিত না হোন, ছেলে/মেয়েকে দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে ভালো নামকরা শিক্ষক দিয়ে বাসায় পড়ালে হয়তো ছেলে শতকরা পঁচানব্বই নম্বর পেয়ে পাশ করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কি নৈতিক হবে? মানবিক হবে? পরমতসহিষ্ণু হবে? আমি মনে করি হবে না। পরিক্ষার মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান কতটুকু তা জানা সম্ভব। সে নৈতিক,মানবিক, পরমত সহিষ্ণু কিনা তা জানার কোন উপায় নেই। এজন্য বলি মায়ের শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত শিক্ষা অসম্ভব।
মায়ের শিক্ষা বীজের মতো। এটা যখন বোনা হয় তখন দেখা যায়না, অংকুরিত হলে কেউ দেখে কেউ দেখেনা, এটা দেখা যায় বড় বৃক্ষ হওয়ার পর। মায়ের শিক্ষার ফল চটজলদি আশা করার নয়।

পূর্বেই বলেছি, শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা মূল্যবোধ লাভ করা যায়। আর এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় সামাজিকীকরণ। সামাজিকীকরণের অন্যতম একটা উপাদান পরিবার। পরিবারের সৃষ্টি মায়ের থেকে, মা ছাড়া পরিবার অকল্পনীয়। শিশুকে নৈতিকতা, মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রভাবক মা। একজন মা তার সন্তানকে যেমন করে গড়ে তুলবেন সে তেমনই হবে।

মায়ের যদি স্বভাব থাকে পরিবারের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার, গালিগালাজ করার- সন্তান ঝগড়া, গালিগালাজ শিখবে। মায়ের যদি স্বভাব হয় সারাদিন স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা, ছোট সন্তানকে খাওয়াতে স্মার্টফোন হাতে দিয়ে শান্ত রাখার- সন্তান অল্প বয়সে হাতে ফোন নিয়ে বিপথে যাবে। মায়ের যদি স্বভাব হয় গীবত করার, অপবাদ দেয়ার- সন্তান মুনাফিক কিসিমের হবে। একের কথা অন্যের কাছে পৌছাবে।

কিন্তু, যদি মা ধৈয্যশীল হন, শান্ত হন, শিক্ষিত হন, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকে, বই পড়েন। আর যদি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা থাকে ঐ মায়ের সন্তান যুগশ্রেষ্ট হওয়াতে আর কোন বাধা থাকে না। এজন্য মায়ের শিক্ষা অত্যন্ত জরুরী। মায়ের শিক্ষা ছাড়া মানব উন্নয়ন সম্ভব নয়।

আমেরিকান ধর্মীয় নেতা Brigham young যথার্থই বলেছেন, ‘you educate a man; educate a man. you educate a woman; you educate a generation’.
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা শিক্ষিত মা চাই, কিন্তু নিজের মেয়েকে, বোনকে শিক্ষিত করার প্রতি আমাদের কোন নজর নেই। মনে রাখবেন, আজকে যেই মেয়েরা চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ে তারাও একদিন কারো না কারো মা হবে। তাদের সন্তানেরা সমাজ চালাবে। সেই সমাজ কেমন হবে তা নির্ভর করবে এই মেয়েটি/মেয়েরা কতটুকু পড়ছে তার উপর।

আমাদের দেশে এখনো মানুষ ছেলেকে পড়ানোতে বেশি জোর দেয়। কারন ছেলে পড়ে চাকরি করে মা-বাবার বরনপোষন করবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এই পড়ালেখা করা ছেলে চাকরি পেয়ে বিয়ে করে বৌয়ের স্বামী হয়ে গেছে। আর সে মা-বাবার সেই ছেলে নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলেদের শিক্ষা অর্থ উপার্জন পর্যন্তই; কিন্তু সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষা সমাজ পরিবর্তনের, মনুষত্বের, আলোকিত বিশ্ব তৈরির, দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনের। জাতিসংঘের ৭ম সমাসচিব কফি আনান যথার্থই বলেছেন- ‘To educate girls is to reduce poverty’.

আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মেয়েরা এখনো বিয়ে পর্যন্তই পড়ে, কেউ তার পূর্বেই বন্ধ করে দেয়। সমাজে এমন চলতে চলতে মেয়েরা এটাকে এখন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে, তারাও পড়তে চায়না। চিন্তা করে বিয়ে হয়ে গেলে সংসারি হয়ে যাবে, পড়ে আর কি লাভ? যারা এমন মনে করেন আপনাদের একটা উদাহরণ দেই, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ)। ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য মেধাবী মহিলা, জীবনে যা কিছু শিখেছেন প্রায় সবকটাই বিয়ের পর।

এজন্য আপনাদের চিন্তায় ও পরিবর্তন দরকার। তার চেয়ে বেশি দরকার আপনাদের পিতা-মাতার চিন্তায়- যারা মনে করে, মেয়ে মানুষ পড়াইয়া কি লাভ, কয়দিন পর তো বিয়ে দিয়ে দিব।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, 

লোকপ্রসাশন বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট।

জুড়ীরসময়/ডেস্ক